আমি জানতাম রাত বারোটা সাড়ে বারোটার আগে কখনো সে ঘুমোয় না। সে রাত্রেও সে জেগেই ছিল। ঘরের দরজাটা ভেজানো ছিল। অবিশ্যি আশাও করি নি যে ঘরের দরজাটা খোলা থাকবে। বলতে পারেন দৈবই আমার সহায় ছিল বোধ হয় সেরাত্রে। নিঃশব্দে ভেজানো দরজাটা একটু ঠেলতেই দরজার কবাট দুটো ফাঁক হয়ে গেল। আর সেই ফাঁক দিয়ে ঘরের মধ্যে দৃষ্টিপাত করেই আমি যেন চমকে উঠলাম। চেয়ারের উপর বসে আছে নরেন আর তার হাতে একটা ছোট কেসে একটা বাদামের আকারের পাথর যার সংকীর্ণ বিচ্ছুরিত জ্যোতি ঘরের টেবিল-ল্যাম্পের মৃদু আলোকে ছাপিয়ে যাচ্ছে যেন। পরে বুঝেছিলাম সেটা একটা দামী। হীরা। সামান্য কয়েকটা মুহূর্ত ইতস্তত করে কমধ্যে প্রবেশ করলাম। নিজের মধ্যে তন্ময় ছিল নরেন তাই বোধ হয় প্রথমটায় ঘরের মধ্যে আমার নিঃশব্দ পদসঞ্চার সে টের পায় নি। কিন্তু আমি দুপা এগুতেই সে টের পেল। চমকে লাফিয়ে উঠে হীরাটা জামার পকেটে লুকিয়ে ফেলে সে তখন উঠে দাঁড়িয়েছে।
কে? এ কি বিনতা তুমি? তুমি এ সময়ে এ ঘরে কেন?
আমার দু-একটা কথা ছিল আপনার সঙ্গে।
আমার সঙ্গে কথা!
হ্যাঁ।
কি কথা তোমার?
কৃষ্ণা কাবেরীর সঙ্গে আপনি মিশতে পারবেন না!
আমার বক্তব্য এত আকস্মিক ও এত বিস্ময়কর যে প্রথমটায় নরেন যেন হতবুদ্ধি হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিয়ে সম্পূর্ণ প্রসঙ্গান্তরে চলে গেল। নিষ্ঠুর হাসিতে তার মুখটা ভরে গেল। এবং প্রায় চাপা কণ্ঠেই সে বলল, তাহলে আমার অনুমান মিথ্যা নয়!
কি বলছেন আপনি?
কি যে ঠিক আমি বলছি তা তুমিও জান! তাহলে তুমি আজো বেঁচে আছে! বলতে বলতে হঠাৎ নরেন এগিয়ে এলো যেন মন্ত্রমুগ্ধের মত। করুণাকরুণা—তুমি তাহলে সত্যিই আজো ঘেঁছে আছো?
সঙ্গে সঙ্গে দুপা পিছিয়ে গিয়ে কঠোর কণ্ঠে আমি বললাম, কি সব পাগলের মত যাতা বলছেন! কে করুণা?
কেন মিথ্যে ছলনা করছে করুণা?
আপনি ভুল করছেন—আমি করুণা নই, আমি বিনতা।
তুমি করুণা নও?
না।
বেশ। করুণা তুমি নও—তুমি বিনতাই, কিন্তু কৃষ্ণা কাবেরীর সঙ্গে তোমার কি সম্পর্ক?
সে শুনে আপনার লাভ নেই। আপনাকে যা বললাম তাই করবেন।
ক্ষণকাল চুপ করে থেকে নরেন বললে, আর তা যদি না করি?
আপনার ভালর জন্যই কথাটা বললাম। যদি আমার কথা আপনি না শোনেন—
না শুনি তত কি?
কৃষ্ণা কাবেরীর বাপ সঞ্জীব চৌধুরীকে সব আমি জানাবো। জানবেন আপনার সত্যিকারের পরিচয় সে জানতে পারলে আপনাকে সে এবারে আর জীবন্ত রাখবে না।
আমার সত্যিকারের পরিচয়?
হাঁ। আমি সব জানি আপনার অতীত ইতিবৃত্ত। যা বললাম মনে থাকে যেন। আমি চললাম। বলে আর এক মুহূর্ত আমি অপেক্ষা করলাম না, ঘর থেকে বের হয়ে এলাম। কিন্তু তারপর কয়েকদিন লক্ষ্য করে দেখলাম, আমার সাবধান বাণী নরেনকে এতটুকুও বিচলিত করতে পারে নি।
তখন অনন্যোপায় হয়ে আমি কৃষ্ণাকেই একটি চিঠি দিলাম রাত্রে গোপনে বাগানে আমার সঙ্গে দেখা করবার জন্য। তাকে নরেন সম্পর্কে সাবধান করে দেবো, যাতে সে কাবেরীকে বুঝিয়ে বলে সময় থাকতে নিবৃত্ত করতে পারে।
নরেনের জন্মতিথির উৎসবের আগের রাত্রে কৃষ্ণা এলো গোপনে বাগানে আমার সঙ্গে দেখা করতে। মা ও মেয়েতে এই প্রথম সামনাসামনি ও প্রথম কথা।
কৃষ্ণা বললে, আপনি আমাকে চিঠি দিয়েছিলেন দেখা করবার জন্য?
হাঁ।
কেন বলুন তো?
এ বাড়ির মালিক নরেন মল্লিকের সঙ্গে তোমরা মিশো না।
কেন এ কথা বলছেন?
তোমাদের মঙ্গলের জন্যই বলছি। তা ছাড়া আমার নিশ্চয়ই ধারণা, তোমরা যে এখানে যাতায়াত কর এবং নরেন মল্লিকের সঙ্গে মেশো নিশ্চয়ই তোমাদের বাবা জানেন না!
আমার শেষের কথায় যেন কৃষ্ণা ভয়ানক চমকে উঠলো।
আপনি—আপনি সে কথা জানলেন কি করে?
মৃদু হেসে বললাম, জানি।
আপনি—আপনি কি আমার বাবাকে চেনেন?
মৃদু, অত্যন্ত মৃদুকণ্ঠে বললাম, এককালে পরিচয় ছিল।
কিন্তু আপনি—আপনি কে?
আমি এ বাড়ির হাউস-মেইড।
না, না—তা নয়। আপনার পরিচয়—কি করে আমার বাবাকে আপনি জানলেন?
তোমার মা আমার বান্ধবী ছিলেন কলেজের ছাত্রীজীবনে।
আপনি তাহলে আমার মাকে জানতেন?
জানতাম। বলেই হঠাৎ যে কি হলো, একটা কথা কৃষ্ণাকে জিজ্ঞাসা করবার লোভ যেন কিছুতেই সামলাতে পারলাম না।
জিজ্ঞাসা করলাম, তোমার-তোমার মাকে মনে আছে কৃষ্ণা?
মা!
হ্যাঁ, মনে আছে তাকে তোমার?
খুব অস্পষ্ট মনে পড়ে, আবছা আবছা—
তোমার বাবার মুখে কোনদিন শোন নি তোমাদের মার কথা?
না। কেবল এইটুকুই একবার শুনেছিলাম—
কি–কি শুনেছিলে?
আমাদের খুব ছোটবেলায় মা নাকি কি একটা অ্যাকসিডেন্টে মারা যান।
অ্যাকসিডেন্টে মারা যান?
হাঁ। তাছাড়া—
তাছাড়া আর কি কৃষ্ণা?
বড় হয়ে ভাল করে জ্ঞান হবার পর বুঝতে পেরেছিলাম, বাবা নিজেও যেমন মার স্মৃতি কখনো মনে করতে চান না তেমনি আমাদেরও মনে করতে দেন নি। তাতেই মনে হয়—
কি?
মার ব্যাপারে বাবার মনের মধ্যে কোথাও যেন একটা মর্মান্তিক দুঃখ লুকিয়ে আছে। তাই আমরাও কখনো ও সম্পর্কে ভুলেও উচ্চবাচ্য করি নি। একটা ছবি পর্যন্ত বাড়িতে কোথাও নেই মার। অথচ–
কি কৃষ্ণা?
মুখে বাবা যাই বলুন না কেন, আমার কিন্তু ধারণা বাবার মনের মধ্যে আজও মা বেঁচে আছেন।
কৃষ্ণা!
হ্যাঁ, কতদিন ঘুমের মধ্যে বাবাকে মার নাম ধরে ডাকতে শুনেছি। তাই তো ব্যাপারটা চিরদিন যেন কেমন গোলমেলে মনে হয়েছে। আচ্ছা আপনি তো মার বান্ধবী ছিলেন, আপনি জানেন কিছু মার অ্যাকসিডেন্টে মৃত্যুর কথা?