সামনে দাঁড়িয়ে নরেন মল্লিকের পুরাতন ভৃত্য মধু ঘোষ। মধুর জবানবন্দীই প্রথমে নেওয়া হয়, কারণ সে-ই ঘরের মধ্যে ঢুকে সর্বপ্রথম এ বাড়িতে মৃতদেহটা দেখতে পায়।
মধু ঘোষ : বেঁটেখাটো লোকটি, দড়ির মত পাকানো দেহের পেশীগুলো অত্যন্ত সজাগ।
মাথার চুলে ইতিমধ্যেই পাক ধরেছে। পরিষ্কার একটা ধুতি ও হাতকাটা একটা পিরান গায়ে। চোখ দুটো ছোট ছোট বর্তুলাকার। এক জোড়া ভারী গোঁফ। সামনের দুটো দাঁত বেশ উঁচু—নিচে ঠোঁটের ওপরে চেপে বসেছে।
তোমার নাম মধু ঘোষ?
আজ্ঞে।
কোথায় বাড়ি?
কাটোয়াতে।
জাত?
গোয়ালা, বাবু!
কতদিন এ বাড়িতে আছো?
আজ্ঞে বাবুর কাছে আজ প্রায় আট বছর আমি কাজ করছি।
আট বছর! তাহলে তো খুব পুরাতন লোক হে তুমি!
আজ্ঞে—
তাহলে বাবুর সঙ্গে তুমি বর্মাতেও ছিলে?
হাঁ। আট বছর আগে বাবু একবার এক মাসের জন্যে কলকাতায় আসেন। বাবুর যে উকীল বন্ধু সমীরবাবু তারই বাড়িতে আমার কাকা কাজ করতো। আমি তখন কাজের খোঁজে নতুন শহরে এসেছি, কাকার কাছেই আছি; বাবুর একজন দেশী লোকের প্রয়োজন হওয়ায়, উকিল বাবুই কাকাকে বলে আমাকে বাবুর কাজে বহাল করে দেন। আমার বয়স তখন বছর পঁচিশেক, সেই হতে এ পর্যন্ত বাবুর কাছেই আছি!
বেশ। আচ্ছা মধু, গতকাল রাত্রে বাবুর সঙ্গে শেষ তোমার কখন দেখা হয়েছিল?
আজ্ঞে রাত সাড়ে দশটায়। দশটা নাগাদ রাতে বাবু বেড়িয়ে ফিরে আসেন। এসে বললেন আমায় ডেকে, ক্ষিধে নেই, কিছুই খাবেন না রাত্রে, কেবল এক কাপ দুধ খাবেন। আমি বিনতা দিদিকে তাই আর তুললাম না ডেকে। দুপুর থেকেই তিনি জ্বর হয়েছিল বলে শুয়ে ছিলেন। আমাকে বলেছিলেন, বাবুর খাবার সময় হলে তাকে ডাকতে কিন্তু বাবু রাত্রে খাবেন না জেনে আর তাকে তুলি নি। অনেক দিন থেকেই রোজ রাত্রে ঘুমোবার আগে বাবুর এক গ্লাস ঠাণ্ডা জল খাওয়ার অভ্যাস ছিল। দুধ খাইয়ে রাত সাড়ে দশটায় ঘরে জলের গ্লাসটা রেখে যাই।
জলের গ্লাসটা রেখে যাবার সময় বাবু কি করছিলেন তোমার মনে আছে মধু?
হ্যাঁ, ঐ ডেক-চেয়ারটার ওপরে বসে একটা বই পড়ছিলেন। আমায় বললেন, যাবার সময় দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে যেতে। দরজা ভেজিয়ে দিয়ে আমি নিচে চলে এলাম।
তারপর?
তারপর বিকালের দিকে কাল বাবুর জন্মতিথি উৎসবের জন্য বিশেষ খাটাখাটনি হওয়ায় সোজা নিজের ঘরে এসে ঘুমিয়ে পড়ি। রোজ খুব ভোরে আবার বাবু এক গ্লাস গরম জল নুন দিয়ে খেতেন। গ্লাসে করে গরম নুনজল নিয়ে আজ সকালে ঘরে এসে ঢুকলাম, তখনও কিছুই জানি না–
একটা কথা মধু, তোমার বাবুর শোবার ঘরের দরজাটা কি বরাবর খোলাই থাকত?
আজ্ঞে হাঁ। খুব ভোরে গরম নুনজল গ্লাসে করে এনে আমিই তার ঘুম ভাঙ্গাতাম। এটা বাবুর ২১/২২ বছরের অভ্যাস। চাকরিতে ঢোকার পর আমিই ঐ কাজটা করতাম।
হাঁ–বল তারপর?
ঘরে ঢুকে বিছানার দিকে এগিয়ে যেতেই দেখতে পেলাম বাবু ঐভাবে মেঝের ওপরে–বলতে বলতে মধু থেমে গেল। সকলের দৃষ্টি মধুর কথা অনুসরণ করে যুগপৎ গিয়ে মেঝেতে কার্পেটের ওপরে যেখানে নরেন মল্লিকের অসাড় প্রাণহীন, ছোরাবিদ্ধ দেহটা পড়ে ছিল, সেই দিকে গিয়ে স্থিরনিবদ্ধ হলো।
দামী কার্পেটের ওপরে ঠিক ডেক-চেয়ারটার সামনেই চিৎ হয়ে পড়ে আছে নরেন মল্লিকের প্রাণহীন দেহটা তখনও।
বামদিককার বক্ষে প্রায় আমূল বিদ্ধ হয়ে আছে সুদৃশ্য কারুকার্যখচিত বাঁটওয়ালা একটা ছোরা। চোখ দুটো যেন ঠেলে বের হয়ে আসতে চায়। অসহায় একটা ভীতি যেন চোখের মণি দুটোয় তখনও স্পষ্ট হয়ে আছে।
ঐভাবে বাবু পড়ে আছেন–রুদ্ধ কান্নাঝরা সুরে কথা কটি যেন কোনমতে শেষ করার জন্যই উচ্চারণ করে মধু। প্রভুর আকস্মিক নিষ্ঠুর মৃত্যুতে মধু যে মনে বিশেষ আঘাত পেয়েছে বুঝতে কারও কষ্ট হয় না।
এতক্ষণে যেন সত্যসত্যই শোকের একটা বিষণ্ণতা নরেন মল্লিকের হত্যাকে কেন্দ্র করে কক্ষের মধ্যে নেমে এলো। থানা-ইনচার্জ খোদাবক্সও ক্ষণেকের জন্য তাঁর লেখা থামিয়ে মৃতের মুখের দিকে চেয়ে থাকেন।
প্রসারিত দেহটা। ডান ও বাম হাতের মুষ্টি দুটো বদ্ধ। মাথাটা এক পাশে ঈষৎ হেলে পড়েছে।
মধুর দুচোখের কোল বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে।
খোদাবক্স আবার তার পেনসিলটা তুলে নিয়ে সম্মুখে টেবিলের ওপরে রক্ষিত খাতার উপরে খস্ খস্ করে লিখে চলেন –
মধু ভয়ে চিৎকার করতে করতে হাউমাউ করে নিচে এসে যদু ও হরিকে সব বলে। সুবিমল তখনও নাকি নিজের কক্ষে ঘুমাচ্ছিল, গিয়ে ডাকাডাকি করে তাকে তোলে। সুবিমলের চোখ থেকে তখনও ঘুমের ঘোর ভাল করে কাটে নি, হতভম্বের মত চেয়ে থাকে ওদের মুখের দিকে কিছুক্ষণ। শেষ পর্যন্ত সুবিমলই ফোন করে পার্ক সার্কাস থানায় সংবাদ পাঠায়।
রবিবার সন্ধ্যায় নরেন মল্লিকের বাড়িতে তার জন্মতিথিকে কেন্দ্র করে যে উৎসবের আয়োজন হয়েছিল অনেকেই তাতে নাকি যোগ দিয়েছিল। উৎসব শুরু হয় বিকাল পাঁচটায় এবং শেষ হয় রাত্রি আটটায়। রাত্রি প্রায় সাড়ে আটটার সময় নরেন মল্লিক গাড়ি নিয়ে বেড়াতে যান। এবং ফিরে আসেন রাত্রি প্রায় দশটায়। ক্ষিদে না থাকায় রাত্রে বিশেষ কিছু খাওয়াদাওয়া করেন নি, কেবল এক গ্লাস গরম দুধ পান করেছিলেন মাত্র।
পরের দিন প্রাতে তাকে বুকে ছোরাবিদ্ধ অবস্থায় মৃত দেখতে পাওয়া গেল শয়নকক্ষের মেঝের উপরে লম্বমান। এবং আশ্চর্য, ছোরাটা নাকি নরেন মল্লিকের নিজেরই ছোরা!