এবারে শুনুন বিনতার ইতিহাস :
মাসচারেক বিনতা বাংলাদেশের একেবারে বহুদূরে এক তীর্থক্ষেত্রে আত্মগোপন করে রইলো। এবং ঐ চার মাস সময়ের মধ্যে প্রচণ্ড এক অগ্নিদাহ চলেছিল বিনতার নিভৃত মনে। এবং সেই অজ্ঞাতবাসের সময়েই বিনতা জানতে পারল যে তার নারীমনের মধ্যে সহজাত যে মাতৃত্ব, যাকে সে এতকাল কণ্ঠরোধ করে অবহেলা ও অবজ্ঞায় অস্বীকার করার চেষ্টা করে এসেছে—কোন নারীই যাকে আজ পর্যন্ত অস্বীকার করতে পারে নি, তাই মনের এক কোণে জ্বলছে যখন প্রতিহিংসার ভয়াবহ অগ্নিস্রোত, অন্য কোণে চলেছে বয়ে নিঃশব্দে অতৃপ্ত মাতৃত্বের স্নিগ্ধ এক ক্ষীণ ধারা এবং একদিন সেই ধারাই তাকে অজ্ঞাতবাস থেকে টেনে নিয়ে এলো কলকাতা শহরে তার ছেড়ে যাওয়া সন্তানদের সন্ধানে। এসে শুনল স্বামী তার সন্তানদের নিয়ে সেই রাত্রেই কোথায় যেন নিখোঁজ হয়েছেন। আরো শুনলো নরেন মল্লিকও বর্মায় গিয়ে আত্মগোপন করেছে। কিন্তু অতৃপ্ত মাতৃত্ব তাকে যেন স্থির থাকতে দিচ্ছিল না। সে বের হলো তার সন্তানদের সন্ধানে এবং শুনে হয়ত আশ্চর্য হবেন, শেষ পর্যন্ত ঘুরতে ঘুরতে সে পেল তার সন্তানদের সন্ধান। দূর থেকে আজ সে শুধু দেখেই তার বুকজোড়া নিধিদের কিন্তু অধিকার নেই তার তাদের স্পর্শ করবার। দূরত্ব রেখেই সে তার সন্তানদের পিছনে পিছনে সর্বত্র ছায়ার মতই ঘুরতে লাগল। ভাবতে পারবেন না মিঃ রায়, এক অভাগিনী জননীর দিনের পর দিন তার বুকভরা স্নেহের সঙ্গে সে কি যুদ্ধ! কত সময় মনে হয়েছে ছুটে গিয়ে তাদের বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরি কিন্তু স্বামীর ভয়ে ও নিজের কলঙ্কিত পরিচয় পাছে তার সন্তানদের শুভ্রতায় কালি ছিটায়, পারেনি সে অভাগিনী নারী কোনদিনই তাদের সামনে দাঁড়াতে। বুকভরা তৃষ্ণার হাহাকার নিয়ে সে দূরে সরে রয়েছে। তারপর দীর্ঘকাল পরে আবার তার স্বামী কলকাতায় এলে তাঁর সন্তানদের নিয়ে। এবং তারই বছর দেড়েক বাদে বর্মা প্রত্যাগত নরেন মল্লিক এসে কলকাতায় জাঁকিয়ে বসল। আপনি বোধহয় বুঝতে পারছেন কৃষ্ণা কাবেরীর অভাগিনী জননীই আমি। নরেন যে কলকাতায় ফিরে এসে জাঁকিয়ে বসেছে আগে কিন্তু তা টের পাই নি। হঠাৎ একদিন রাত্রে নরেনকে পার্ক সার্কাসের একটা স্টেশনারী দোকানে দেখে চমকে উঠলাম। তার পাশে ছিল কাবেরী। দোকানের উজ্জ্বল বৈদ্যুতিক আলোয় এতকাল পরে নরেনকে দেখেও আমার চিনতে কষ্ট হয় নি। কিন্তু নরেনকে দেখে যতখানি না চমকে ছিলাম, তার চাইতেও বেশি চমক লেগেছিল আমার সেরাত্রে নরেনের পাশে আমার মেয়ে কাবেরীকে দেখে। আমার কাজকর্ম করবার জন্য ও আমাকে সদাসর্বদা দেখাশোনা করবার জন্য একটি পাহাড়ী ভৃত্য ছিল বীরবাহাদুর। তাকে নিযুক্ত করলাম নরেনের সমস্ত সন্ধান নেবার জন্য। সে-ই আমাকে নরেনের সব সংবাদ এনে দিল। তার মুখেই শুনলাম নরেনের গৃহে কৃষ্ণা কাবেরী দুজনারই যাতায়াত আছে। শয়তান নরেন মল্লিককে আমি চিনি। সে একদিন আমার জীবনে রাহুর মত উদয় হয়ে আমার সর্ব গ্রাস করেছিল, আজ আবার সে আমার আত্মজাদের জীবনে রাহুর মত উদয় হয়েছে। বহুদিনের পুরাতন ক্ষতে আবার নতুন করে রক্ত ঝরতে লাগল। নরেনের হাত থেকে যেমন করেই হোক আমার কৃষ্ণা ও কাবেরীকে বাঁচাতে হবে প্রতিজ্ঞা করলাম। কিন্তু কেমন করে? এমন সময় ভগবানই যেন হাতে আমার সুযোগ এনে দিলেন। নরেন একজন হাউস-মেইডের জন্য সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন দিয়েছিল। একটা দরখাস্ত ছেড়ে দিলাম। অনেকের সঙ্গে নয়, মাত্র তিনজনের ইন্টারভিউ হলো। লক্ষ্য করেছিলাম আমার কণ্ঠস্বর শুনেই নরেন যেন হঠাৎ চমকে উঠেছিল। তারপর নানাভাবে আমাকে একটার পর একটা প্রশ্ন করে যেতে লাগল। বুঝেছিলাম আমাকে সে তার পূর্বপরিচিত সন্দেহ-বশেই যাচাই করে দেখছিল—তার সন্দেহ বা অনুমান সত্য কিনা। কি বুঝল জানি না, তবে আমাকেই সে কাজে বহাল করলো।
মাথায় দীর্ঘ অবগুণ্ঠন টেনে থাকলেও এবং কারো সঙ্গে একমাত্র মধু ছাড়া ও বাড়িতে কোন প্রকার কথাবার্তা না বললেও, দুটি কান আমার সর্বদা সজাগ থাকত। চক্ষুও আমার সজাগই থাকত অবগুণ্ঠনের তলায়।
কিছুদিন যেতেই দুটি ব্যাপার নজরে পড়লো। একটি হচ্ছে কৃষ্ণা ও কাবেরীর নরেনের গৃহে যাতায়াত আছে। এবং নরেন ওদের মধ্যে কৃষ্ণার প্রতি আসক্ত ও কাবেরী নরেনের প্রতি আসক্ত। এবং দ্বিতীয়তঃ কৃষ্ণা ও কাবেরীর মধ্যে কাবেরীই যেন পেয়েছে আমার অতীতের মনোবৃত্তি। কৃষ্ণা হয়েছে তার বাপের মত স্থির ধীর ও সংযত। আরো একটা ব্যাপার লক্ষ্য করেছিলাম, সুবিমল কাবেরীর প্রতি আসক্ত কিন্তু কাবেরী সুবিমলকে নিয়ে খেললেও তার নজর ছিল আসলে নরেনের প্রতি নয়, তার সঞ্চিত বা অর্জিত অর্থের প্রতি। সঙ্গে সঙ্গে আমি সাবধান হলাম,-সতর্ক হলাম, যাতে করে নরেনের দ্বারা ওদের কোন অনিষ্ট না হয়। জানতাম আমি, মধ্যে মধ্যে রাত্রে কাবেরী বাগানের দ্বারপথে ঘোরানো সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠে বাথরুমের দরজাপথে নরেনের ঘরে গিয়ে প্রবেশ করত। তাদের দেখাসাক্ষাৎ হতো রাত্রে গোপনে। ঐ ব্যাপারটাই আমাকে সত্যিকারের চঞ্চল করে তোলে। অর্থের লোভে কাবেরীর নরেনের গৃহে রাত্রের ঐ গোপন অভিসার যে একদিন কাবেরীর সর্বনাশ ডেকে আনবে এ যেন কেন মন আমার পূর্বেই বলেছিল। তাই একদিন শেষ পর্যন্ত কাবেরীর মঙ্গলাকাঙ্ক্ষায় ভীতা আমি রাত্রে নরেনের শয়নঘরে গিয়ে প্রবেশ করলাম।