উচ্ছৃঙ্খল জীবনে তার হৃদয় বলে কোন পদার্থই ছিল না। অর্থাৎ দেহের অভ্যন্তরে যে একটা মন থাকতে পারে তার সন্ধান সে কোন দিনই পায় নি। রূপমুগ্ধ পুরুষদের নিয়ে খেলা করাই ছিল তার একমাত্র কাজ। এবং সেই সঙ্গে সঙ্গে শোষণ। এমনি করে যখন জীবনের একুশটা বছর কেটে গিয়েছে, এমন সময় দেখা হলো তার একটি পুরুষের সঙ্গে কোন একটি পার্টিতে, যে পুরুষটির তথাকথিত ঐসব মেয়েদের সম্পর্কে কোন জ্ঞানই ছিল না। পুরুষটির তখন বয়স চল্লিশের কোঠা ছাড়িয়ে চলেছে।
ধীর, সৌম্য, শান্ত, রূপবান এবং অবস্থা খুব ভাল। কলকাতায় তিন-চারখানা বাড়ি, মোটা ব্যাংক-ব্যালেন্স। পুরুষটিও পার্টিতে প্রথম দিন সেই মেয়েটিকে দেখেই মুগ্ধ হলো। মেয়েটিরও যে পুরুষটির উপরে কিছুটা দুর্বলতা জেগেছিল সেদিন অস্বীকার করা যায় না। যাহোক সেই পার্টির পর থেকেই দুজনার মধ্যে আলাপ জমে উঠলো। মেয়েটির মা একদিন বললে, যদি বিয়ে করতে হয় তো একেই কর। গোবেচারী ধরনের লোক। টাকাকড়ি যথেষ্ট আছে। বয়সও হয়েছে। একে তুই অনায়াসেই মুঠোর মধ্যে রেখে নিজের খুশিমত জীবনটা কাটিয়ে দিতে পারবি। তাছাড়া আজ রূপ-যৌবন আছে, কিন্তু একদিন যখন ওসব কিছুই থাকবে না তখন একটা শক্ত আশ্রয় না পেলে বাঁচতে পারবি না। মেয়েটিও ভেবে দেখলো, কথাটা নেহাৎ মিথ্যা নয়। যার ফলে মেয়েটির সঙ্গে পুরুষটির বিবাহ হয়ে গেল।
কিন্তু কয়েক মাস না যেতেই দুটি সত্য মেয়েটির চোখের সামনে অত্যন্ত স্পষ্ট হয়ে উঠলো। তার একটি হচ্ছে, নির্বিবাদী শান্ত ও সংযমী পুরুষ হলেও তার স্বামীর মনের মধ্যে একটা লৌহ কঠিন পৌরুষ আছে যা সহজে বিদ্রোহ ঘোষণা করে না বটে কিন্তু একবার বিদ্রোহী হলে তাকে শান্ত করা স্বয়ং বিধাতারও দুঃসাধ্য। দ্বিতীয়, লোকটির অসম্ভব এবং অত্যুগ্র একটা আভিজাত্য ও রুচিবোধ আছে। যার ফলে কারোই সহজ চলার পথে সে অনিচ্ছা থাকলেও বাধা দেয় না। এবং ঠিক দুটি কারণেই মেয়েটি বিবাহের পরও যখন তার স্বামীকে সম্পূর্ণ অবজ্ঞা করেই নিজের গতানুগতিক উচ্ছৃঙ্খলতার মধ্যে গা ভাসিয়ে চলতে লাগল, স্বামীর গৃহ থেকে বহুদিন পর্যন্ত কোন বাধাই পায় নি—আর ঐটাই হলো তার জীবনের সব চাইতে বড় ভুল। যে ভুলের প্রায়শ্চিত্ত তাকে সর্বস্ব দিয়ে করতে হলো। বেঁচে থেকেও তিলে তিলে প্রতি মুহূর্তে মৃত্যুযন্ত্রণা ভোগ করতে কাউকে দেখেছেন কি মিঃ রায়! ধারণা করতে পারবেন না—সে কি যন্ত্রণা সে কি দাহ!
যাক যা বলছিলাম—বুঝতে পারছেন বোধ হয় সেই মেয়েটিই আমি! বিবাহের দুই বৎসরের মধ্যেই আমি মা হলাম। কিন্তু তবু হতভাগিনী আমার চোখ খুলল। যে মাতৃত্ব নারীকে দেয় নতুন জীবন, যে মাতৃত্ব নারীর জীবনে আনে অমৃতের স্বাদ, সে মাতৃত্ব পেয়েও আমি সুধা ফেলে গরলের পিছনেই ছুটতে লাগলাম! আকণ্ঠ গরল পান করেই নেশায় বুদ হয়ে রইলাম। সেই গরলই হচ্ছে আপনাদের ঐ নরেন মল্লিক। নরেনের দুটো নাম ছিল—একটা পোশকী, একটা সর্বত্র চলতি। চলতি নামটা আর করবো না, নরেন নামটাই বলি।
জানি না সদ্য বিলাত-প্রত্যাগত ঐ নরেন কি কুক্ষণেই আমার সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল। ঐ নরেনই শেষ পর্যন্ত আমার এত দুঃখের কারণ, নরেনই দিল আমাকে যত উৎসাহ, যত বুদ্ধি-বুদ্ধি নয় বলবো দুর্বুদ্ধি!
স্বামী আমার কোন কাজেই বাধা দেন না। মুক্ত স্বাধীন আমি। যথেচ্ছাচার ও উচ্ছৃঙ্খলতার মধ্যে দিন কাটছে। আর বিশ্বাস করে স্বামী তার যে অর্থ ও সম্পত্তি আমার হাতে তুলে দিয়ে নিশ্চিন্ত ছিলেন–সেই অর্থ ক্রমে ক্রমে নিঃশেষ হয়ে আসছে। কিন্তু জেনেও বুঝতে পারি নি, চোখ আমার খোলে নি যে প্রায়শ্চিত্তের দিন আমার এগিয়ে এসেছে।
হঠাৎ তারপর একদিন এলো আমার স্বামীর চিঠি, কলকাতার বাস উঠিয়ে এবার তার কাছে যেতে হবে। তখনও ভেবেছি ও কিছু না। কেবল একটা নিছক হুমকিই বুঝি। আর নরেনও তাই আমাকে বোঝাবার চেষ্টা করল। কিন্তু অকস্মাৎ যেদিন স্বামী এসে হাজির হলেন, তার মুখের দিকে দৃষ্টিপাত করেই বুঝলাম, কোথায় যেন সত্যিকারের গণ্ডগোল ঘটেছে। আমার ভাগ্যাকাশে কত বড় দুর্যোগের মেঘ ঘনিয়ে এসেছে। চারিদিকে ঘনিয়ে এসেছে ঝড়ের কালো মেঘ! সুখের স্বপ্ন আমার ভাঙার মুখে। কিন্তু মানুষের দুর্ভাগ্য, রাহু যখন একবার তাকে গ্রাস করে মুক্তি যে তার সহজে মেলে না তা তো বুঝি নি। তাই সেদিন রাত্রেই গৃহে ফিরে স্বামীর কণ্ঠস্বরে সেই মেঘই যখন গর্জে উঠলো, তখনই স্পষ্ট বুঝলাম আগুন জ্বলছে এবং ভয়াবহ সে আগুন মেলেছে শত শত লোল বাহুঁ। রক্ষে নেই আর। মুহূর্তে সে আগুন আমার সর্বাঙ্গে বেষ্টন করে ধরল। পদাঘাতে বিতাড়িত হলাম আমি সেই রাত্রেই স্বামীগৃহ থেকে। ধাক্কা খেয়ে সিঁড়ি দিয়ে গড়াতে গড়াতে নীচে এসে পড়লাম কিন্তু তবু মৃত্যু আমাকে আশ্রয় দিল না। দেবেই বা কেন? পাপের প্রায়শ্চিত্ত যে তখনও আমার পূর্ণ হয় নি। রক্তাক্ত মুখে ছুটে গেলাম সেই রাত্রেই নরেনের গৃহে। কিন্তু সেখানে গিয়ে দেখিনরেন তখন আর এক নারীর আলিঙ্গনে বদ্ধ। একে অপমানের জ্বালায় পুড়ছিলাম, তার উপরে নরেনের সেই মিথ্যাচার প্রতারণা আমাকে যেন একেবারে হিতাহিত-জ্ঞানশূন্য করে তুলল। নরেনকে আঘাত দেবো বলে পাগলিনীর মত যেমন তার দিকে এগিয়ে গিয়েছি সে আমাকে দিল একটা প্রচণ্ড ধাক্কা। সামলাতে না পেরে গিয়ে পড়লাম টেবল-ল্যাম্পটার ওপরে। বিস্ফোরণের শব্দ। সঙ্গে সঙ্গে জ্ঞান হারালাম। তিন দিন পরে জ্ঞান ফিরে এলো হাসপাতালে। সমস্ত মুখে ব্যাণ্ডেজ বাঁধা। টেবল-ল্যাম্পটা ফেটে সমস্ত মুখটা ক্ষতবিক্ষত হয়ে গিয়েছিল, পরে জানতে পারি। এবং হাসপাতাল থেকে তারপর বের হয়ে এলাম একদিন মুখের উপরে অবগুণ্ঠন টেনে। সেই হলো নবজন্ম। নাম নিলাম বিনতা।