কিন্তু যা ও জানে না তার জন্য ওকে আপনারা পীড়ন করবেন? বিশ্বাস করুন আমার কথা মিঃ রায়, ও কোন কথাই গোপন করে নি কৃষ্ণা সম্পূর্ণ নিরপরাধ। করুণ মিনতিতে যেন সঞ্জীব চৌধুরীর কণ্ঠস্বর ভেঙে গুড়িয়ে গেল।
কিন্তু আমি বলছি, উনি—আপনার বড় মেয়ে কৃষ্ণা দেবী অনেক কিছুই গোপন করে রেখেছেন। কৃষ্ণা দেবী, আমার দিকে ফিরে তাকান, এখনো বলুন সব কথা!
কৃষ্ণা যেন পাথর। কেবল দেহই নয়, যেন তার অনুভূতিও পাথর হয়ে গিয়েছে। নিষ্কম্প ভাবলেশহীন দৃষ্টি।
কৃষ্ণা দেবী, আর চুপ করে থেকে লাভ হবে না! বলুন, কি আপনার বলবার আছে?
আমি—আমি কিছুই জানি না। এতক্ষণে ক্ষীণকণ্ঠে প্রত্যুত্তর শোনা গেল কৃষ্ণার।
আপনি কিছুই জানেন না?
না।
বেশ। তবে সে রাত্রে অর্থাৎ ২৭শে পৌষ রবিবার, যে-রাত্রে নরেন মল্লিক নিহত হয়, সেরাত্রে কেন গিয়েছিলেন মল্লিক ভবনের পিছনদিককার বাগানে?
বাগানে আমি যাই নি।
আমি জানি আপনি গিয়েছিলেন এবং তার প্রমাণও আমার হাতে আছে। কঠোর প্রতিবাদ জানায় কিরীটী।
প্রমাণ।
হাঁ। দেখুন তো এটা চিনতে পারেন কিনা? বলতে বলতে পকেট থেকে একটা গগলস্ বের করে হাতটা সামনের দিকে তুলে ধরল কিরীটী, চিনতে নিশ্চয়ই কষ্ট হচ্ছে না আপনার যে এটার মালিক আপনিই! দেখুন, ভাল করে চেয়ে দেখুন—চশমাটার উঁটে দেখুন লেখা আছে কৃষ্ণা ইংরাজীতে। নিশ্চয়ই কোন একসময় নিজের নামটা ডাঁটের গায়ে কুঁদে নিয়েছিলেন, পাছে আপনার বোন কাবেরী দেবীর চশমার সঙ্গে গোলমাল হয়ে যায় বলে, তাই নয় কি? এটা আমি কুড়িয়ে পেয়েছি বাগানে ডালিয়ার ঝাড়ের কাছে।
কৃষ্ণা একেবারে নির্বাক নিষ্কম্প।
চুপ করে আছেন যে! এ চশমাটা কি আপনার নয়?
হাঁ আমারই।
তাহলে এবার বলুন কেন সেরাত্রে বাগানে গিয়েছিলেন? কারো সঙ্গে দেখা করতে কি?
হাঁ।
কার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন? বিনতা দেবী, না মিঃ মল্লিকের সঙ্গে?
কিরীটীর কথায় যেন ভূত দেখার মতই চমকে মুখ তুলে তাকাল কৃষ্ণা ওর মুখের দিকে।
চমকে উঠবেন না। কিন্তু বুঝতেই পারছেন যে, আমি জানি যে বিনতা দেবীর সঙ্গে আপনার আলাপ ছিল!
সঞ্জীব চৌধুরী চিৎকার করে ওঠেন এমন সময় সহসা, কৃষ্ণা!
কিন্তু কিরীটী সে চিৎকারে যেন ভূক্ষেপও করল না। কৃষ্ণার মুখের দিকে তাকিয়েই আবার প্রশ্ন করল, কি করে আপনার বিনতা দেবীর সঙ্গে আলাপ হলো, বলবেন কি?
তিনিই আমাকে চিঠি দিয়ে ডেকে নিয়ে গিয়ে আলাপ করেছিলেন। মৃদু ক্ষীণ কণ্ঠে কৃষ্ণা প্রত্যুত্তর দেয়।
হাঁ। তাহলে সেই আলাপের সূত্র ধরেই তিনি এখানেও ইদানীং মধ্যে মধ্যে রাত্রে এসে আপনার সঙ্গে দেখা করতেন তাই বোধ হয়, না?
কিন্তু জানেন কি তাঁর সত্যিকারের পরিচয়টা?
না।
জানেন না?
না।
সত্যি বলছেন, জানেন না? তিনিও কখনও তাঁর পরিচয় দেন নি?
না।
সেরাত্রে তাহলে আপনি বাগানে তারই সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন?
হাঁ।
কেন?
তিনি ডেকে পাঠিয়েছিলেন।
কেন?
তার কিছু কথা আমাকে বলবার ছিল তাই।
কি কথা জানতে পারি কি?
ক্ষমা করবেন। বলতে পারবো না।
ঠিক ঐ সময় চন্দ্রনাথ এসে ঘরে প্রবেশ করল। কিরীটী চন্দ্রনাথের মুখের দিকে তাকিয়ে ব্যাকুল কণ্ঠে প্রশ্ন করল, কি খবর চন্দ্রনাথ? তুমি একা?
তাঁকে পাওয়া গেল না সে-বাড়িতে।
পেলে না?
না। আজ সকালেই তিনি সে-বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছেন।
কোথায় কিছু জানতে পারলে?
না। কেউই তা বলতে পারল না। তবে—
কি?
বাড়িওয়ালার হাতে তিনি আপনার নামে একখানা চিঠি দিয়ে গিয়েছেন যাবার আগে। চিঠি!
হ্যাঁ, এই যে, চন্দ্রনাথ জামার পকেট থেকে একটা মুখ-আঁটা পুরু সাদা খাম নিঃশব্দে এগিয়ে দিল কিরীটীর দিকে।
মুখ-আঁটা খামটার উপরে পরিষ্কার অক্ষরে বাংলায় লেখা—শ্ৰীযুক্ত কিরীটী রায় সমীপেষু। ঘরের মধ্যে উপস্থিত অন্যান্য সকলেই তখন স্তব্ধ বিস্ময়ে কিরীটী ও চন্দ্রনাথের পরস্পরের কথোপকথন শুনছিল। কিরীটী খামটা ছিঁড়ে ফেলল। ভিতর থেকে বের হলো একখানা চিঠি। দীর্ঘ তিনপৃষ্ঠা ব্যাপী। কিরীটী চিঠিটা পড়তে লাগল।
কিরীটীবাবু,
আপনি সেরাত্রে ঠিকই আমাকে চিনেছিলেন, ভুল আপনার হয় নি। ভেবেছিলাম কাউকে কিছু না জানিয়েই নিঃশব্দে চিরদিনের মত সরে যাবো। কিন্তু পরে ভেবে দেখলাম নরেন মল্লিকের হত্যার ব্যাপারে আমার নিজস্ব বক্তব্যটুকু অন্তত যদি না জানিয়ে যাই শেষ বিদায়ের আগে, কোন তৃতীয় নিরপরাধ ব্যক্তি হয়তো শেষ পর্যন্ত নরেন মল্লিকের হত্যাপরাধের সন্দেহে অযথা পীড়িত হবে। সেও একটি কথা এবং নরেনের হত্যা-ব্যাপারটার সঙ্গে এমন দুজন জড়িত আছে যাদের চাইতে প্রিয় এ জগতে আমার আর কিছুই নেই—এবং বিশেষ করে শেষোক্ত কারণেই এই চিঠিখানা যাবার আগে আপনাকে লিখে গেলাম।
সেদিন রাস্তার মাঝখানে গ্যাসের আলোয় আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আপনার চোখে যে বিস্ময় ফুটে উঠেছিল তা আমার নজর এড়ায় নি। কিন্তু সে বিস্ময়কে জানতে হলে আমার অতীত কাহিনী আপনার জানা প্রয়োজন। শুধু তাই নয়, আমার কথা বুঝতে হলেও আমার অতীত না জানলে সবটা ঠিক বুঝে উঠতে পারবেন না।
আজ থেকে প্রায় কুড়ি বছর আগেকার কথা। কাহিনী হচ্ছে একটি তথাকথিত আলট্রামডার্ন বা আলোকপ্রাপ্তা(?) শিক্ষিতা(?) তরুণীর কাহিনী। ভগবান রূপ দিয়েছিলেন তার দেহে অকৃপণভাবে ঢেলে। কিন্তু জ্ঞান হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই অর্থাৎ তার দেহে যখন কৈশোর এলো তখন থেকেই তার মা তাকে তার রূপ সম্পর্কে এমন আত্মসচেতন করে তুলেছিল যে যৌবন তার দেহে আসবার আগেই রূপের দেমাকে হয়ে উঠেছিল সে আত্মহারা, তার সঙ্গে মায়ের শিক্ষায় হয়ে উঠেছিল সে উদ্ধৃঙ্খল বেপরোয়া। মার কাছ থেকে সে শিক্ষা পেয়েছিল, নারীর রূপ হচ্ছে পুরুষ-পতঙ্গকে পোড়াবার জ্বলন্ত অগ্নিশিখা এবং যে মেয়ে সে নীতিকে জীবনে না অনুসরণ করে, তার দুঃখের আর সীমা থাকে না। বোকা মেয়ে তাকেই জীবনের পরম সত্য বলে মেনে নিয়ে এগিয়ে চলল।