এমন সময় রহমান, ডাক্তার সুকুমার ও কৃষ্ণা এসে কক্ষে প্রবেশ করল।
আসুন কৃষ্ণা দেবী! কিরীটীই আহ্বান জানাল।
কাবি? কৃষ্ণা বলে ওঠে।
অকস্মাৎকৃষ্ণার কণ্ঠস্বর শুনে কাবেরী যেন বিদ্যুৎগতিতে উঠে দাঁড়ায় এবং উন্মাদিনীর মতই কৃষ্ণার দিকে চিৎকার করে ছুটে যায়, খুন করবো তোকে সর্বনাশী! তুই-তুই-তুই-ই আমার
জীবনের সব চাইতে বড় শত্রু!
মুহূর্তে কিরীটী এগিয়ে এসে কাবেরীকে প্রতিরোধ করে, কাবেরী দেবী!
না—না, আমায় ছেড়ে দিন আমায় ছেড়ে দিন। ওকে ওকে আমি খুন করবোই।
কিরীটীর বজ্রমুষ্টি হতে নিজেকে ঝাঁকি দিয়ে মুক্ত করবার চেষ্টা করতে করতে চিৎকার করে
কাবেরী বলতে থাকে।
কাবেরী দেবী! দুহাতে কাবেরীর স্কন্ধের দুপাশ দৃঢ় মুষ্টিতে চেপে প্রচন্ড এক ঝাঁকুনি দিয়ে কঠোর কণ্ঠে বলে ওঠে কিরীটী, চুপ করে বসুন–না হলে বাধ্য হবো আমি আপনার হাতে হাতকড়া লাগাতে!
কাবেরী সোফাটার উপরে বসে পড়ে সোফার মধ্যেই মুখ গুঁজে ফুলে ফুলে কাঁদতে থাকে। মিনিট পাঁচ-সাত কিরীটী কাবেরীকে কঁদতে দেয়। কিছুক্ষণ কেঁদে কাবেরী একটু সুস্থ হলে কিরীটী ডাকে, কাবেরী দেবী, এখন নরেন মল্লিককে কেন খুন করতে–
খুন—হ্যাঁ, খুন নরেনকে আমি করতে চেয়েছিলাম, কিন্তু পারি নি—শুধু নরেনকে কেন, একই সঙ্গে দিদি কৃষ্ণাকেও!
কিন্তু কেন—কেন ওদের খুন করতে চেয়েছিলেন? কথাটা বলে ওঠেন রহমান সাহেব।
কেন খুন করতে চেয়েছিলাম! জঘন্য, হীন প্রতারকরাগে উত্তেজনায় কাবেরীর সমগ্র মুখখানি যেন রক্তচাপে লাল হয়ে ওঠে, কেন খুন করতে চেয়েছিলাম জিজ্ঞাসা করছেন? ভাবতে পারেন, যাকে সমস্ত প্রাণ দিয়ে আমি ভালবেসেছিলাম—যাকে ভালবেসে জীবনের নীতিকে বর্জন করেছি, পিতার স্নেহ-ভালবাসাকে উপেক্ষা করেছি, পিতাকে প্রতারণা করেছি, সেই শঠ প্রতারক নরেন—যখন জানতে পারলাম আসলে সে কৃষ্ণাকেই ভালবাসে, আমাকে নয়, আমার প্রতি ভালবাসা তার অভিনয় মাত্র, দিনের পর দিন আমার বুকভরা ভালবাসাকে নিয়ে সে ছিনিমিনি খেলেছে, পদদলিত করেছে—ভাবতে পারেন নারী হয়ে সে কি মর্মান্তিক লজ্জা, কি দুঃসহ বেদনা! শঠ, নীচ, প্রতারক!
কিরীটী বাধা দিয়ে বলে, কিন্তু তাই যদি হয় সে তো ওর দোষ নয়!
আবার ক্ষেপে ওঠে কাবেরী এবং কৃষ্ণার দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে বলে, দোষ নয়? ওরই দোষ-ঐ—ঐ শয়তানীকে সে ভালবাসতো অথচ পরিচয় আগে তার আমার সঙ্গেই। আমিই কৃষ্ণার সঙ্গে পরে তার পরিচয় ঘটিয়ে দিয়েছিলাম। দিনের পর দিন প্রলোভনের জাল বিস্তার করে, প্রেমের ভালবাসার অভিনয় করে আমাকে আকর্ষণ করেছে, এমন কি চোরের মত লুকিয়ে ওর বাড়ির পশ্চাতের দ্বার দিয়ে রাত্রে সেই শঠ প্রতারকের সঙ্গে গিয়ে মিলিত হয়েছি। কিন্তু যেদিন বুঝলাম আসলে সে আমাকে চায় না, চায় কৃষ্ণাকেই—স্থির করলাম তাকে খুন করবো-শুধু তাকেই নয়, কৃষ্ণাকেও!
বুঝতে পারছি এখন আপনার তখনকার মনের অবস্থা কাবেরী দেবী সহানুভূতির সঙ্গে কিরীটী বলে।
কতটুকু বুঝতে পেরেছেন সে জ্বালা, সে দাহ! না না, কেউ বুঝতে পারে না—আমার মত যে না জ্বলেছে সে ছাড়া কেউ বুঝতে পারে না, পারবে না। হ্যাঁ, তারপর থেকেই সুযোগ খুঁজতে লাগলাম। প্রতিশোধ! প্রতিশোধ! সুযোগ এলো। জন্মতিথি উৎসবে নরেন আমায় নিমন্ত্রণ করলে না, করলে কৃষ্ণাকে—রাত্রে তার ওখানে যাওয়ার জন্য। চিঠি নন্দুয়ার হাতে পাঠিয়েছিল, আমার হাতে এসে পড়লো। এই সুযোগ। লুকিয়ে ফেললাম চিঠিটা। অফিস হতে ঐদিনই কৃষ্ণার পরিচয়ে নরেনের সঙ্গে appointment করলাম রাত্রি সাড়ে আটটায় দেশপ্রিয় পার্কে দেখা করবার জন্য।
তারপর? রুদ্ধ নিঃশ্বাসে কিরীটী প্রশ্ন করে।
কৃষ্ণার পরিচয়েই দেশপ্রিয় পার্কে কৃষ্ণার মত সাজসজ্জা করে ঠিকসময় নরেনের সঙ্গে দেখা করলাম—বললাম, চিঠি পেয়েছি। রাত বারোটায় তার শয়নকক্ষে গিয়ে দেখা করবো, সে যেন বাথরুমের দরজাটা খুলে রাখে। আমার কথা শুনে আনন্দে সে উল্লসিত হয়ে উঠলো। এতদিন সে আমার সঙ্গে অভিনয় করে এসেছে, কিন্তু এমন নিখুঁত অভিনয় সেরাত্রে আমি তার সঙ্গে করলাম ধরতে পারলে না সে!
একটু থেমে কাবেরী আবার বলতে লাগল, আগেই একটা ছোরা কিনে রেখেছিলাম বাড়িতে ফিরে দেখি কৃষ্ণাও ইতিমধ্যে ঘরে ফিরে এসেছে। বুকের মধ্যে প্রতিশোধের আগুন নিয়ে, কোনমতে মুখে চারটি খুঁজে তাড়াতাড়ি শয্যায় গিয়ে কৃষ্ণার সঙ্গে শুয়ে পড়লাম যে যার পৃথক শয্যায়। ঠিক রাত যখন সাড়ে এগারটা, নিঃশব্দে শয্যার ওপরে উঠে বসলাম।
ঘর অন্ধকার। অন্ধকারেই চেয়ে দেখলাম, কৃষ্ণা তার শয্যায় শুয়ে অঘোরে ঘুমোচ্ছে। সন্ধ্যা থেকে বাবার শরীর খারাপ বলে বাবা নাকি কৃষ্ণা যখন সন্ধ্যার সময় বের হয় তাকে বলেছিলেন বিরক্ত না করতে। ঘরের আলো নিভিয়ে তিনি শুয়ে পড়েছিলেন আমাদের আগেই।
বাবার ঘরের দিকে তাকালাম, কোন সাড়াশব্দই নেই। পা টিপে টিপে শয্যা হতে উঠে, প্রথমেই কোমরে ছোরাটা গুঁজে নিয়ে নিঃশব্দে পাশের কক্ষে চলে এলাম। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে বেশ ভাল করে সাজলাম। অভিনয় করতে চলেছি। অভিনয়—অভিনয়ের শেষরাত্রি। লাল রক্তবর্ণ শাড়ি পরলাম। মাথার চুল এলোখোঁপা করে বেঁধে, ঠিক কৃষ্ণার মত করে তার ব্রোচটা শাড়িতে এঁটে, তার ভেইলটা মাথার ওপরে দিয়ে রাস্তায় এসে নামলাম। হনহন করে হেঁটে চললাম নরেনের বাড়ির দিকে। নির্জন রাস্তা, একটুকু ভয় করে নি আমার।