বলুন? বলুন? কিরীটী প্রশ্ন করে।
রক্ত! তার কাপড়ে রক্তের দাগ! অকারণে একটা ভয়ে বুকের ভিতরটা আমার কেঁপে উঠলো। বললাম, এত রাত পর্যন্ত কোথায় ছিলি? আমার প্রশ্নের কোন জবাব না দিয়ে সে সোজা শয়নকক্ষের দিকে চলে গেল। কিছুক্ষণ হতভম্বের মত দাঁড়িয়ে থেকে আমি যখন শয়নকক্ষে প্রবেশ করলাম, দেখলাম ঘর অন্ধকার। আর সেই অন্ধকার ঘরে কার চাপা কান্নার শব্দ যেন গুমরে গুমরে উঠছে। পরের দিন সকালে ঘুম ভেঙে উঠে দেখি কাবেরী তখনও ঘুমিয়ে—তার ডিউটির সময় হয়েছে, তবু তাকে না জাগিয়ে আমি একাই ডিউটিতে চলে যাই।
***
ঠিক এমনি সময়ে বাইরে একটা মোটর গাড়ি এসে থামবার শব্দ শোনা গেল। কাবেরী একটু থেমে আবার বলতে শুরু করে, অফিসে সে সেদিন একটু লেটেই এলো। পাশাপাশি বসে দুজনে কাজ করছি, তবু কেউ কারও সঙ্গে কথা বলছি না।
বাইরের বারান্দায় একটা শব্দ শোনা যায়—খট্ খট্ খট্। খট খট শব্দটা ক্রমে যেন ঐ ঘরের দিকেই এগিয়ে আসছে।
খট খট শব্দে সকলেরই দৃষ্টি সেদিকে আকর্ষিত হয়। ক্রাচে ভর দিয়ে দরজার উপরে এসে দাঁড়ালেন সঞ্জীব চৌধুরী। চোখে মুখে তার উদ্বেগের সুস্পষ্ট চিহ্ন।
সঞ্জীবকে দরজার গোড়ায় দেখেই হঠাৎ কাবেরী চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় এবং তার বিস্মিত কণ্ঠ হতে অর্ধস্ফুট একটা আর্ত শব্দ নির্গত হয়, বাবা!
কাবেরী কোথায়? সত্যিই কি সে মোটর-অ্যাকসিডেন্টে মারা গিয়েছে? বলতে বলতে সঞ্জীব চৌধুরী কমধ্যে এসে প্রবেশ করেন এবং পরক্ষণেই কাবেরীকে অদূরে দণ্ডায়মান দেখে বলে ওঠেন, কিন্তু এই তত—এই তো! তবে—তবে যে কে এক ডাক্তার ফোনে বললে, তুমি—তুমি নাকি মোট অ্যাকসিডেন্টে মারা গেছে!
সঞ্জীবের কথায় কাবেরীর মুখখানা যেন সহসা ছাইয়ের মত রক্তশূন্য ফ্যাকাশে হয়ে যায়। বিহ্বল বোবাদৃষ্টিতে সে তাকায় বাপের মুখের দিকে।
কিরীটীর কণ্ঠস্বর হঠাৎ শোনা গেল, তাহলে আপনি—আপনিই কাবেরী চৌধুরী! এতক্ষণ তাহলে কৃষ্ণা চৌধুরীর পরিচয়ে ধোঁকা দিচ্ছিলেন! মারা গেছেন তাহলে আসলে কৃষ্ণা দেবীই কাবেরী চৌধুরী নন?
আমি-আমি–, কি যেন কাবেরী বলবার চেষ্টা করে।
কিরীটী ঘুরে সঞ্জীব চৌধুরীকে সম্বোধন করে প্রশ্ন করে, মিঃ চৌধুরী, তাহলে ইনিই কাবেরী। দেবী?
নিশ্চয়ই। আমার মেয়েকে আমি চিনি না! ঐ তো আমার ছোট মেয়ে কাবেরী—কিন্তু–
হঠাৎ কাবেরী যেন পাগলের মত চিৎকার করে ওঠে, না না, আমি কাবেরী নয়—আমি কৃষ্ণা। বাবা, তুমি কি আমায় চিনতে পারছো না? চেয়ে দেখো ভাল করে চেয়ে দেখো বাবা, আমি–আমি কাবেরী নই, আমি—আমি তোমার কৃষ্ণা।
কৃষ্ণা! হঠাৎ হাঃ হাঃ হাঃ করে পাগলের মত হেসে ওঠেন সঞ্জীব চৌধুরী, তুই কৃষ্ণা, হ্যাঁ। তুই কৃষ্ণা! হাঃহাঃহাঃ! পাগলের মতই হাসতে থাকেন সঞ্জীব চৌধুরী।
কাবেরী ছুটে এসে তার বাপ সঞ্জীব চৌধুরীকে দুহাতে আঁকড়ে ধরে আর্ত ব্যাকুল কণ্ঠে বলে ওঠে, বাবা–বাবা! আমি—আমি সত্যিই তোমার কৃষ্ণা! দেখো, আমি সত্যিই তোমার বড় মেয়ে কৃষ্ণা—
য়াঁ! হঠাৎ হাসি থামিয়ে বোবাদৃষ্টিতে তাকান সঞ্জীব মেয়ের মুখের দিকে। তারপর অধস্ফুট স্বরে বলেন, তুমি—তুমি তাহলে কাবেরী নও? তুমি কৃষ্ণা? তাহলে—তাহলে কৃষ্ণা মরে নি—মরেছে কাবেরী? না না, তা কি করে হবে? কাবেরী কাবেরী! কৃষ্ণ কৃষ্ণা! না না, আমি যাই—আমি যাই—
ক্রাচে ভর দিয়ে অস্থিরভাবে খট খট শব্দ তুলে সঞ্জীব ঘর থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে গেলেন।
আর কাবেরী হঠাৎ চেয়ারটার উপরে বসে দুহাতে মুখ গুঁজে ফুলে ফুলে কাঁদতে থাকে। ঘরের মধ্যে উপস্থিত সকলেই ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে রোরুদ্যমানা কাবেরীর দিকে।
হঠাৎ কাবেরী উঠে পড়ে। তারপর বলতে বলতে বের হয়ে যায় ঘর হতে, বাবা–বাবা, শোন—শোন, দাঁড়াও!
অবিনাশ ও রহমান দুজনেই কাবেরীকে অনুসরণ করতে যাচ্ছিল, কিরীটী ওদের বাধা দিয়ে বলে, না, ওঁকে যেতে দিন রহমান সাহেব।
.
কক্ষের মধ্যে যেন নাটকের একটা দৃশ্য অভিনীত হয়ে গেল।
কাবেরী ও তার পিতা সঞ্জীব চৌধুরীর পরস্পরের মধ্যে কথাবার্তাগুলো নরেন মল্লিকের হত্যাকে কেন্দ্র করে গত ২৭শে পৌষ যে রহস্যজাল বিস্তৃত করেছিল এ যেন তারই সমাপ্তির রূঢ় ইঙ্গিত। সকলেই চুপচাপ দাঁড়িয়ে, কারো মুখে কথাটি পর্যন্ত নেই।
সর্বপ্রথম কথা বললে কিরীটী, এতটা আমি ভাবি নি। অন্ধকারে নিক্ষিপ্ত তীর অব্যর্থ লক্ষ্যভেদ করেছে।
রহমান বললেন, কাবেরীকে ওভাবে না যেতে দিলেই কি ভালো হতো না মিঃ রায়!
কিরীটী মৃদু হেসে বললে, ভয় নেই রহমান সাহেব, এ অজগরের গ্রাস, একবার যখন দাঁত বসিয়েছে, পূর্ণগ্রাসের থেকে আর ও নিস্তার পাবে না।
ইতিমধ্যে একসময় ডাঃ সুকুমারও কক্ষে এসে প্রবেশ করে একপাশে স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তার দিকে তাকিয়ে কিরীটী বললে, ডক, this is the world! কিন্তু আমি বলছি তুমি ঠকে নি!
ঠিক এমনি সময়ে একটা গাড়ি এসে থামবার শব্দ পাওয়া গেল।
কে এলো?
দেখুন তো রহমান সাহেব কে এলেন!
রহমানকে আর বাইরে বের হয়ে দেখতে হলো না, তালুকদার কক্ষে প্রবেশ করলে, চোখেমুখে তার সুস্পষ্ট একটা উত্তেজনার ভাব।
ব্যাপার কি তালুকদার সাহেব?
জব্বর সংবাদ! উত্তেজিত ভাবে তালুকদার বলে।
হেঁয়ালি ছেড়ে বল, বর্মা থেকে কোন সংবাদ পেয়েছ বোধ হয়!