আমি—আমি তার dead bodyটা একবার দেখতে পারি না! অ্যাপ্রন পরা ডাক্তারটি বললে, আসুন—পাশের ঘরেই আছে।
সুকুমার ডাক্তার ও নার্সের সঙ্গে পাশের ঘরে গিয়ে প্রবেশ করে পর্দার ওপাশে।
.
একটা চেয়ারের উপরে মুহ্যমানের মত বসেছিল কাবেরী। মনের মধ্যে যে তার প্রচণ্ড একটা ঝড় বয়ে যাচ্ছে, তার চোখ-মুখ দেখে তা বুঝতে কষ্ট হয় না।
একসময় পায়ে পায়ে কিরীটী কৃষ্ণার ছদ্মবেশে কাবেরীর ঠিক সামনে এগিয়ে এসে মৃদু কণ্ঠে বলে, মাপ করবেন, যিনি মোটর অ্যাসিডেন্টে একটু আগে মারা গেছেন, আপনার চেহারার সঙ্গে তার চেহারার অদ্ভুত একটা সৌসাদৃশ্য আছে বলে মনে হচ্ছে, আপনারা
হ্যাঁ, সে আমারই যমজ বোন কাবেরী।
ঠিক ঐ সময়ে ইনসপেক্টার মজিবুর রহমান এসে কক্ষে প্রবেশ করে কাবেরীকে অদূরে উপবিষ্ট দেখেই বলে ওঠে, আপনি এখানে?
হাঁ ইনপেক্টার, আমার বোন কাবেরী—
I see! আপনারই বোন তাহলে মোটর অ্যাকসিডেন্টে—
হাঁ।
নরেন মল্লিক মার্ডার কেসের একজন suspect তাহলে দুর্ঘটনাতেই শেষ পর্যন্ত শেষ হয়ে গেলেন! কতকটা যেন আত্মগতভাবেই কথাটা উচ্চারণ করলেন মজিবুর রহমান।
ইনসপেক্টার! কাবেরীর ডাকে রহমান ওর দিকে তাকান।
আমি আপনাকে কিছু বলতে চাই—
কি বলুন তো?
আজ আর আপনার কাছে কোন কথাই গোপন করবো না ইনসপেক্টার—
ইনপেক্টার মজিবুর রহমান আবার কাবেরীর মুখের দিকে তাকালেন।
কাবেরী বলতে লাগল, কারণ যেজন্য সেদিন বাধ্য হয়েই আমাকে গোপনতার আশ্রয় নিতে হয়েছিল আজ আর তার প্রয়োজন নেই। কাবেরীর দুচোখে অশ্রু ঘনিয়ে আসে। চোখের জল মুছে কাবেরী বলে, যাকে পুলিসের সন্দেহ থেকে বাঁচাবার জন্য সেদিন—মায়ের পেটের বোন হয়ে মিথ্যার আশ্রয় আমাকে নিতে হয়েছিল, হতভাগিনী সে-ই যখন আজ আর বেঁচে নেই—
একটু অপেক্ষা করুন মিস্ চৌধুরী! কাবেরীর বক্তব্যে বাধা দিয়ে হঠাৎ অদূরে দণ্ডায়মান যুবকটির দিকে তাকিয়ে রহমান বলে, অবিনাশ, কৃষ্ণাদেবীর জবানবন্দিটা টুকে নাও। Yes—হ্যাঁ, এবারে বলুন মিস চৌধুরী কি বলছিলেন!
কাবেরী অরুদ্ধ কণ্ঠে বলতে শুরু করে, আমাদের বাবা সঞ্জীব চৌধুরীকে আপনি জানেন ইনপেক্টার। আমাদের দুই বোনের স্বাধীনতা বলতে সত্যিকারের কিছুই ছিল না। বাড়িতে এবং বাইরে সর্বদা যেন বাবার হাজারটা অদৃশ্য চক্ষু আমাদের প্রতি সজাগ হয়ে থাকত। একান্ত অর্থাভাবের জন্যই আমাদের দুই বোনকেই টেলিফোনের কাজ নিতে হয়েছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও কারও সঙ্গে, বিশেষ করে কোন পুরুষেব সঙ্গেই আমাদের দুবোনের কারোই। আলাপ-পরিচয় করবার বা মিশবার উপায় ছিল না। বাবার কড়া আদেশ ছিল, কোন পুরুষের সংস্রবেই যেন আমরা না যাই।
আপনাদের বিবাহ দেবার ইচ্ছাও তার ছিল না? প্রশ্ন করে কিরীটী।
না। বাবা বলতেন, বিবাহ করলেই নাকি আমরা পর হয়ে যাব। বাবার তা সহ্য হবে না। আমাদের ছেড়ে তিনি থাকতে পারবেন না।
তারপর? রহমান বলে।
কিন্তু বাবার এত সাবধানতা, সদাসতর্ক ও জাগ্রত দৃষ্টি আমাদের ওপরে থাকা সত্ত্বেও কাবেরী যেন কোন্ একাকে মৃত নরেন মল্লিকের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল—আমি বা বাবা প্রথমটায় আদপেই তা টের পাইনি। পরে যখন জানতে পারলাম—
আপনার বাবা তাহলে শেষ পর্যন্ত কাবেরী দেবীর মৃত নরেন মল্লিকের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার কথা জানতে পেরেছিলেন? প্রশ্ন করে কিরীটী।
আচমকা কিরীটীর প্রশ্নে কাবেরী যেন চমকে ওঠে। তারপর মৃদু কণ্ঠে বলে, নিশ্চয়ই জানতেন। এত বড় একটা ব্যাপার তার দৃষ্টিকে এড়িয়ে যাবে তা মোটেই সম্ভব নয়।
তারপর আপনার বাবা ঐ ব্যাপার জানা সত্ত্বেও কোনরকম গোলমাল করেন নি বা বাধা দেন নি? কিরীটী আবার প্রশ্ন করে।
না।
আশ্চর্য! বলুন, তারপর?
মধ্যে মধ্যে গোপনে আমাদের বাড়ির সামনেই যে পার্কটা আছে, সেখানে নরেন মল্লিক কাবির সঙ্গে এসে দেখা করতে এবং পার্কেই একদিন তার সঙ্গে কাবির মধ্যস্থতাতে আমারও আলাপ হয়।
আচ্ছা একটা কথা কৃষ্ণা দেবী—কিরীটী প্রশ্ন করে।
বলুন?
মিঃ নরেন মল্লিক ও আপনার বোন কাবেরী দেবী, এদের মধ্যে, মানে পরস্পরের মধ্যে পত্রবিনিময় হতো কিনা আপনি জানেন কিছু?
কি জানি, বলতে পারি না ঠিক। আর হলেও আমার নজরে কখনও পড়ে নি।
হুঁ, বলুন—তারপর?
তারপর সেই ২৭শে পৌষ রবিবার যেদিন রাত্রে নরেন মল্লিক তার শয়নকক্ষে ছুরিকাঘাতে নিহত হন—
কিরীটী লক্ষ্য করে কাবেরীর চোখে-মুখে হঠাৎ যেন একটা অদ্ভুত পরিবর্তন সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে, চোখের দৃষ্টি স্থিরনিবদ্ধ, সমগ্র মুখখানি রক্তচাপে রক্তিম হয়ে উঠেছে, গলার দু পাশে ও কপালের দুদিককার শিরাগুলো আরো স্পষ্ট ও সজাগ হয়ে উঠেছে, নাসিকার অগ্রভাগ ফুলে ফুলে উঠছে।
কাবেরী বলতে থাকে ও আমাদের দুবোনেরই সেদিন সন্ধ্যা থেকে পরের দিন সকাল আটটা পর্যন্ত off-duty ছিল। সন্ধ্যার কিছু পরেই সাজগোজ করে কাবেরী বের হয়ে যায় বাড়ি থেকে। রাত্রি এগারটা সাড়ে এগারটা পর্যন্ত অপেক্ষা করে সে যখন ফিরল না, বাইরের ঘরে তার অপেক্ষায় সোফার ওপরে বসে একটা বই পড়তে পড়তেই বোধ হয় ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, হঠাৎ মৃদুভাবে দরজার গায়ে শব্দ শুনে ঘুমটা ভেঙে গেল। মনে হলো চাপা গলায় কে যেন ডাকছে : দিদিদিদি! উঠে দরজা খুলে দিতেই দেখি—কাবেরী! কাবেরী ঘরে এসে প্রবেশ করল। ঘরের উজ্জ্বল আলোয় কাবেরীর দিকে তাকিয়েই চমকে উঠলাম। তার চোখে অদ্ভুত একটা দৃষ্টি। আর—আর–