কাবেরী সুকুমারের কথার কোন জবাব দেয় না, নিঃশব্দে বসে বসে শাড়ির আঁচলের পাড়টা টানতে থাকে।
কিন্তু তোমরা ওভাবে ব্যাপারটার অতটা importance দিলেও আমি কিন্তু ততটা চিন্তিত নই। একটা লোকের অদ্ভুত একটা খেয়াল নিয়ে আর দশজনের জীবন নিয়ন্ত্রিত হবে কেন? কিন্তু তা ছাড়াও যে জিনিসটা আমাকে মধ্যে মধ্যে চিন্তিত করে তোলে সেটা—
কি?
মনে পড়ে পার্ক সার্কাসে নরেন মল্লিকের হত্যার ব্যাপারে পুলিসের কর্তৃপক্ষ তোমাদের দুবোনকে suspect–
সুকুমারের কথাটা শেষ হল না, কাবেরী তীব্র কণ্ঠে বলে ওঠে, nonsense! কোথায় কি? কারো সঙ্গে কোন সম্পর্ক নেই। কিন্তু পুলিসের সন্দেহের কথা ছেড়েই দাও, তুমি—তুমিও কি—
আমি? আমার কথা না হয় ছেড়েই দাও, কিন্তু একটা সন্দেহের দুঃস্বপ্ন অবিরত আমাদের পিছনে পিছনে তাড়া করে ফিরবে এও তো–
কিন্তু আমি তোমার কথাই জানতে চাই।
অন্য কথা না হয় ছেড়েই দিচ্ছি কিন্তু এটা তো ঠিকই, তোমাদের দুবোনের মধ্যে একজন নরেন মল্লিককে চিনতে–
সুকুমার!
হ্যাঁ, এটা শুধু মুখের কথা নয়, সাক্ষীপ্রমাণও যে তার আছে। সত্য যা একদিন না একদিন তা দিনের আলোর মত আত্মপ্রকাশ করবেই, সেদিন—একটু থেমে হঠাৎ সুকুমার আবার বলে, অন্তত আমার কাছে তুমি সব কথা খুলে বল কৃষ্ণা, সত্যিই যদি তুমি আমাকে ভালবাস, এ যন্ত্রণা থেকে আমাকে নিষ্কৃতি দাও। আমাদের পরস্পরের প্রেমের মধ্যে এই যে সন্দেহের একটা কালো রাহু এ থেকে আমাকে মুক্তি দাও।
কাবেরী যেন পাষাণের মতই স্থির, অনড়। চোখের দৃষ্টি অকম্পিত।
কৃষ্ণা!
বল।
বল, বল কৃষ্ণা, সত্যিটুকু আমাকে খুলে বল! সহসা এগিয়ে এসে দুহাতে কাবেরীর একখানা হাত তুলে ধরে আবেগকম্পিত কণ্ঠে কথা কটি বলে সুকুমার।
সহসা কাবেরী সুকুমারের মুষ্টি হতে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে দুহাতের মধ্যে মুখ গুঁজে অশ্রুরুদ্ধ কণ্ঠে বলে ওঠে, না না, আমি কিছু জানি না—আমি কিছু জানি না—
কৃষ্ণা!
সস্নেহে কাবেরীর অবনত পৃষ্ঠে একখানা হাত রেখে সুকুমার বলে, আমায় তুমি বিশ্বাস টী
না, না—আমায়—আমায় তুমি ক্ষমা করো সুকুমার। আমি কিছু জানি না জানি না। কাবেরী উঠে দাঁড়ায়, তার কোলের ওপর থেকে ভ্যানিটি ব্যাগটা মাটিতে পড়ে যায়।
নিচু হয়ে ব্যাগটা তুলতে গিয়ে সুকুমারের নজর পড়ল, ব্যাগটার গায়ে বড় বড় অক্ষরে লেখা ও কাবেরী।
ঠিক এমনি সময় টেলিফোন বেজে ওঠে : ক্রিং! ক্রিং! ক্রিং!
সুকুমার তাড়াতাড়ি এগিয়ে গিয়ে ফোনটা তুলে নেয়, হ্যালোর্য্যা, হাঁDr. Gupta speaking. কি—কি বললেন, হ্যাঁ, accident! Motor accidentয়ে মারা গেছেন? হাঁ। হাঁ আসছি, এখুনি আসছি–
কি–কি ব্যাপার সুকুমার? প্রশ্ন করে কাবেরী।
বড় sad news কৃষ্ণা! তোমার বোন কাবেরী, মানে—
কি–কি হয়েছে কাবির? বল—বল সুকুমার, চুপ করে রইলে কেন, বল?
সে, মানে, কাবেরীর মোটর অ্যাসিডেন্ট—। মুহূর্তে কাবেরীর সমগ্র মুখখানা যেন রক্তহীন, ফ্যাকাশে হয়ে যায়। একটা আর্ত অস্ফুট চিৎকার কাবেরীর কণ্ঠ হতে নির্গত হয়। কাবেরী মুহ্যমানের মত সোফাটার ওপরেই ধপ করে বসে পড়ে।
সুকুমার কাবেরীর পাশে এসে দাঁড়ায়, সস্নেহে ধীর কণ্ঠে বলে, এ সময় নার্ভ হারালে তো চলবে না কৃষ্ণা—চল বরং তোমাকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে আমিই হাসপাতালে যাই।
না, না—আমি—আমিও তোমার সঙ্গে যাবো সুকুমার—
তুমি যাবে?
হাঁ। আমায়—আমায় তুমি নিয়ে চল।
বেশ চল।
দুজনে উঠে দাঁড়ায়। গাড়িতে উঠে সুকুমার গাড়িতে স্টার্ট দিল। গাড়ি ছুটে চলল। হাসপাতালের দিকে।
সার্কুলার নার্সিং হোম। সুকুমারের গাড়ি কাবেরীকে সঙ্গে নিয়ে এসে নার্সিং হোমের কম্পাউণ্ডে প্রবেশ করল। নার্সিং হোমের কক্ষে কক্ষে খোলা জানালাপথে নজরে পড়ে ডোমেঢাকা স্বল্প পাওয়ারের মৃদু আলোর আভাস। বাইরের মৃদু আলোকিত বারান্দায় একটি যুবক বোধ হয় ওদেরই অপেক্ষায় দাঁড়িয়েছিল, বললে, ডাক্তার গুপ্ত?
হাঁ।
এইদিকে আসুন।
যুবকের সঙ্গে সঙ্গে তাকে অনুসরণ করে সুকুমার আর কাবেরী আললাকিত নাতিপ্রশস্ত একটি কক্ষমধ্যে এসে প্রবেশ করে। অল্পবয়েসী একজন নার্স বিমর্ষ মুখে দাঁড়িয়ে আর ঘরের মধ্যে অস্থির অশান্ত পদে কিরীটী পায়চারি করছে। স্বল্পবয়েসী একজন ডাক্তার অ্যাপ্রন গায়ে একপাশে দাঁড়িয়ে।
ওদের কক্ষমধ্যে প্রবেশ করতে দেখেই কিরীটী ডাক্তারকে আহ্বান জানায়, এই যে ডাক্তার, আসুন।
ব্যাপার কি বলুন তো মিঃ রায়? কি করে দুর্ঘটনা ঘটল?
সত্যিই বড় দুঃখের ব্যাপার। আমারই গাড়ির নীচে হঠাৎ—মানে আমি আমীর আলি অ্যাভিনু দিয়ে ঐ ভদ্রলোকের সঙ্গে গাড়িতে করে আসছিলাম, রাস্তা অনেকটা খালি থাকায় বেশ জোরেই গাড়ি চালিয়ে আসছিলাম, হঠাৎ আচমকা মেয়েটি ছুটে রাস্তা cross করতে গিয়ে আমার সামনে এসে পড়ে, আমি থামাতে পারলাম না, ফলে—
আঘাত, মানে—
মাথাটা একেবারে চাকার তলে পড়ে সঙ্গে সঙ্গেই অজ্ঞান হয়ে যান, একটু আগে কয়েক সেকেণ্ডের জন্য মাত্র জ্ঞান হয়েছিল, কি সব নরেন মল্লিকের হত্যার ব্যাপার, আপনার নাম, কৃষ্ণা না কাবেরী—কি সব যেন বললেন। আপনার নামটা আমার জানা ছিল, ফোন গাইড থেকে আপনার নাম খুঁজে বের করে তাই আপনাকেই ফোন করেছি। আর একটু আগেও যদি আসতেন ডাঃ গুপ্ত, হয়ত শেষ দেখাটা হতো