সুকুমার ভূ-কুঞ্চিত করে একবার সেই তরুণীটির দিকে তাকিয়ে হলের অন্যদিকে কৃষ্ণাকে নিয়ে সরে যায়।
একটু পরেই শ্ৰীমন্ত মুখার্জীর গান শুরু হলো। আধুনিক এক গীতিকারের একটি আধুনিক গান প্রথমে গাইতে আরম্ভ করেন শ্ৰীমন্ত মুখাজী। একটি বিরহের সঙ্গীত।
গানের সুরে সবাই মশগুল, কৃষ্ণাও মুগ্ধ হয়ে যায় শ্রীমন্ত মুখার্জীর গান শুনে, মুগ্ধবিস্ময়ে সে একপাশে বসে গান শুনতে থাকে। ঐ অবসরে নিঃশব্দে অন্যের অলক্ষ্যে সেই ঘর থেকে বের হয়ে পাশের ঘরে গিয়ে ছোট একটা টেবিলের উপরে রক্ষিত ফোনটার রিসিভারটা তুলে নেয়? Please put me to south…
***
ফোন সেরে হলঘরে ফিরে এসে দেখে কৃষ্ণা সেখানে নেই। সুকুমার হলঘরের সামনের টানা বারান্দায় বের হয়ে আসে। লম্বা টানা বারান্দা মৃদু আলোয় ছায়াচ্ছন্ন, রেলিংয়ের ধার দিয়ে সব টবে পামট্রি বসানো, ঝুড়িতে নানাজাতীয় সব অর্কিড়। একপাশে অন্ধকারে রেলিংয়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়েছিল কৃষ্ণা নিঃশব্দে যেন ছায়ার মত।
সুকুমার এগিয়ে এসে ডাকে, কৃষ্ণা!
কে? চম্কে ফিরে তাকায় কৃষ্ণা, বলে, ওঃ তুমি! হঠাৎ আমাকে একা ওখানে ফেলে কোথায় গিয়েছিলে?
কিন্তু তুমি এখানে যে—গান ভাল লাগল না?
মাথাটা হঠাৎ বড্ড ধরেছে—তাই এখানে খোলা জায়গায় একটু—
চল গঙ্গার ধারে খানিকটা না হয় ঘুরে আসি, মাথাটা ছেড়ে যাবেখন।
না। আমাকে বাড়ি পৌঁছে দাও সুকুমার।
হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে সুকুমার বললে, রাত মাত্র তো সবে সাড়ে আটটা, এখুনি বাড়ি যাবে?
হ্যাঁ, চল—
কি ভেবে সুকুমার বলে, বেশ চলল।
বাড়ির কাছে এসে সুকুমার কৃষ্ণাকে নামিয়ে দেয়।
Good night—সুকুমার বলে।
Good night!
সুকুমারের গাড়ি চলে গেল।
কৃষ্ণা কিন্তু বাড়ির মধ্যে ঢুকল না, সামনের পার্কের দিকে এগিয়ে গেল। পার্কটি তখন প্রায় নির্জন হয়ে এসেছে, কেবল দুচারজন ইতস্তত পরিক্রমণ করছে। কৃষ্ণা একটা বেঞ্চের উপরে গিয়ে বসল।
.
টেলিফোন অফিস।
কাবেরীর ডিউটিও শেষ হয়ে গিয়েছিল রাত্রি সাড়ে আটটায়। তাড়াতাড়ি বাড়িতে ফিরে বেশভূষা করে আবার কাবেরী অফিসেই ফিরে এল।
সুকুমারকে বলেছে সে, রাত দশটায় duty off হবে—সে আসবে এখানে। অপেক্ষা করতে থাকে কাবেরী সুকুমারের জন্য অপারেটরদের বিশ্রামকক্ষে বসে। হাতঘড়িতে ঠিক দশটা বাজতেই কাবেরী বেশভূষাটা ঠিক করে উঠে দাঁড়াল।
বাড়ি থেকে বেরুবার আগেই কাবেরী বেশভূষার মধ্যে সামান্য অদলবদল করে নিয়েছিল, এবং নিজের নাম লেখা ভ্যানিটি ব্যাগটা আনবে না ভেবেও দৈবক্রমে কৃষ্ণার নাম লেখা ব্যাগটা আনতে গিয়ে নিজেরটাই নিয়ে এসেছিল অজ্ঞাতে। আর কৃষ্ণা লেখা ব্রোটা শাড়ির ওপরে কাঁধে এঁটে এসেছে। গেটের কাছে আসতেই দেখলে সুকুমারের গাড়ি আসছে।
সুকুমার গাড়িটা গেটের কাছে এনে দাঁড় করিয়ে গাড়ির সামনের দরজাটা খুলে দিয়ে কাবেরীকে আহ্বান জানাল, এসো কৃষ্ণা।
কাবেরী মৃদু হেসে গাড়িতে উঠে সুকুমারের পাশের সীটে এসে বসল, খুব punctual তো?
হ্যাঁ, বিশেষ করে মহিলাদের সঙ্গে appointment ঠিকমত রক্ষা করতে না পারলে
আজকালকার দিনে কি চলে!
তাই নাকি?
নিশ্চয়ই।
পাতলা একটা স্নিগ্ধ সুবাস কাবেরীর বেশভূষা থেকে ছড়িয়ে যাচ্ছে।
যদি কিছু মনে না কর কৃষ্ণা, বাড়িটা একবার ঘুরে যেতে চাই—
বাঃ, কি আবার মনে করবো, চল!
.
কাবেরী লক্ষ্য করে নি, অদূরে সুবিমলও ঠিক ঐ সময়টিতে তার ফ্লুইড় ড্রাইভ ডজ গাড়িতে বসে ওদের দিকে সজাগ দৃষ্টি রেখেছিল। ডাক্তার ও কাবেরীর সম্পর্ক কিছুদিন হতেই তার মনের মধ্যে একটা সন্দেহের ছায়াপাত করেছিল। ..
তাই কিছুদিন হতে কাবেরীকে সে অলক্ষ্যে অনুসরণ করছিল। কাবেরীকে ডাক্তারের গাড়িতে উঠতে দেখে ব্যাপারটা ঠিক সে বুঝে উঠতে পারল না, তা ছাড়া কৃষ্ণা বলে ডাক্তারের ডাকটাও তাকে কতকটা বিভ্রান্ত করেছিল। ডাক্তারের গাড়ি চলে যেতে সুবিমলও গাড়িতে স্টার্ট দিয়ে অন্যদিকে চলে গেল।
সুকুমারের গাড়ি তার বাড়ির কম্পাউণ্ডে এসে প্রবেশ করলো।
এসো কৃষ্ণা—সুকুমার আহ্বান জানায় কাবেরীকে দরজা খুলে। দুজনে এসে সুকুমারের চেম্বারে প্রবেশ করলবোস।
সুকুমারের নির্দেশে কাবেরী একটা সোফার উপরে উপবেশন করে।
হঠাৎ তোমার আজকে বেড়াবার ও হোটেলে ডিনার খাবার শখ হলো যে সুকুমার? কাবেরী প্রশ্ন করে।
কাবেরীর সুকুমার সম্বোধনে সুকুমার প্রথমটায় চমকে ওঠে, কিন্তু মুহূর্তে নিজেকে সামলে নিয়ে বলে, কি ভোলা মন তোমার কৃষ্ণা, এর মধ্যেই পরশু রাতের কথা ভুলে গেলে? কি কথা হয়েছিল আমাদের লেকের ধারে বসে?
এবারে কাবেরীর চমকাবার পালা, কিন্তু কাবেরীর হাবভাবে এতটুকু সেটা প্রকাশ পেল না, বরং মৃদু হেসে বললে, সত্যিই তো! দেখেছো কি ভোলা মন আমার, একেবারেই ভুলে গিয়েছিলাম।
তারপর সহসা একসময় সুকুমার কাবেরীর মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে, একটা কথার সত্য জবাব দেবে কৃষ্ণা?
বল, কি কথার জবাব চাও?
সত্যি কি তুমি কিছু বুঝতে পারো নানা বুঝেও বুঝতে চাও না?
বুঝতে যে পারি না তা নয়—তাছাড়া সত্যিই এই দূরে দূরে থাকতে ভালও লাগে না, কিন্তু–
কিন্তু কি কৃষ্ণা?
ভাবছি বাবার কথা। তিনি যদি রাজী না হন?
নাই-বা হলেন রাজী, তাই বলে চিরকালটা এমনি করেই জীবন কাটাতে হবে নাকি? এমনি করেই তোমাদের দুটি বোনের জীবন ব্যর্থ হয়ে যাবে নাকি?