মূর্তিটা যেন একটু নত হয়ে কুর্নিশ জানাবার ভঙ্গী করে এবং পরক্ষণেই একপাশে অন্ধকারে মিলিয়ে যায়।
প্রায়ই এর পর থেকে ছায়ামূর্তি চোখে পড়তে লাগল নরেন মল্লিকের। কখনো পাশ দিয়ে হেঁটে যায়, কখনো গাড়িতে করে পাশ কাটিয়ে চলে যায়। কখনো দূরে দাঁড়িয়ে থাকে। কখনো ছায়ার মত দীর্ঘ পা ফেলে ফেলে হেঁটে অথবা গাড়িতে চড়ে অনুসরণ করে।
একদিন গভীর রাত্রে ঘুম ভেঙ্গে শয়নকক্ষের খোলা জানালার সামনে এসে দাঁড়াতেই নজরে পড়লো–বাড়ির অল্পদূরে গ্যাসপোস্টটার নিচে দাঁড়িয়ে সেই দীর্ঘ ছায়ামূর্তি–মুখ তুলে অপলকে যেন তারই ঘরের দিকে তাকিয়ে আছে।
শুধু নরেন মল্লিকেরই না, ড্রাইভার নন্দুয়ার দৃষ্টিতেও পড়ে। সেও দেখে কালো রংয়ের। একটা সেলুনগাড়ি যেন প্রায়ই নিঃশব্দে ওদের গাড়িকে অনুসরণ করছে। কখনো অনুসরণ করে একটা চকিত প্রহেলিকার মত, কখনো সোঁ করে পাশ কাটিয়ে চলে যায়। কখনো বা শোনা যায় একটা অস্পষ্ট শব্দ।
নন্দুয়া অবশেষে একদিন বলে, একটা কথা বলবো বাবু—
কি নন্দুয়া?
মাঝে মাঝে কিছুদিন থেকে মনে হচ্ছে যেন একটা কালো রংয়ের গাড়ি আমাদের গাড়ির পিছু আসছে—
হেসে ওঠে নরেন মল্লিক, যাঃ! কে আবার follow করবে? ও তোর দেখবার ভুল নন্দুয়া
না বাবু—
যা যা–ওসব কিছু না।
উড়িয়ে দিতে চাইলেও একটা বোবা আশঙ্কা নরেনের মনকে যেন আচ্ছন্ন করে রাখে সর্বদা। ক্লেদাক্ত একটা অক্টোপাশের অষ্টবাহু যেন নরেনের সর্বাঙ্গ বেষ্টন করতে চাইছে। শয়নে, স্বপনে, জাগরণে একটা অনিশ্চিত আশঙ্কা, বিশ্রী একটা দুঃস্বপ্নের মতই ওকে যেন। তাড়া করে ফেরে সর্বদা। অবাধ হাসি ও আনন্দের মধ্যে ঐ দুঃস্বপ্ন যেন নরেন মল্লিককে চঞ্চল, আনমনা করে তোলে। চোখেমুখে একটা দুশ্চিন্তার কালো রেখা যেন স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
বন্ধু সমীরের দৃষ্টিকেও এড়াতে পারে না নরেন মল্লিক। কথা বলতে বলতে হঠাৎ কেমন চমকে চমকে ওঠে। ভীত, শঙ্কিত দৃষ্টিতে এদিক ওদিক তাকায়।
সমীর একদিন প্রশ্ন করে, ব্যাপার কি বল্ তো নরেন? আজকাল কিছুদিন হতে তোকে যেন কেমন চঞ্চল অন্যমনস্ক মনে হয়! হঠাৎ কেমন চম্কে চমকে উঠিস, কি ব্যাপার বল্ তো?
না না–ও কিছু নয়।
উঁহু, আমার কাছে গোপন করছিস তুই! Keeping some secret-no no my dear friend—আমার চোখে তুই ধুলো দিতে পারবি না। Be frank!
এবারেও কিন্তু নরেন মল্লিক চুপ করেই থাকে।
আমার কাছেও গোপন করবি নরেন?
আজ নয় সমীর, অন্য এক সময় বলবো-অন্য এক সময় বলবো। বলতে বলতে হঠাৎ যেন নরেন মল্লিক কেমন অন্যমনস্ক হয়ে গেল।
নরেন?
Its a long story সমীর! তারপর একটু চুপ করে থেকে হঠাৎ আবার মৃদু চাপাকণ্ঠে বলে, রাজার ঐশ্বর্য! বহু রাজার রত্নভাণ্ডারেও নেই! বলতে বলতে আবার চুপ করে গেল। নরেন মল্লিক।
সমীর বুঝতে পারে। একটা রহস্য যা নরেন গোপন করতে চাইছে, কিন্তু কি এ রহস্য! নরেন বলে, তোকে বলবো সমীর, হ্যাঁ, একদিন তোকে সব বলবো। সাজাহানের ময়ূরসিংহাসন আলো করেছিল। এক হাত থেকে আর এক হাত-হস্তান্তর হতে হতে বাকীটুকু আর শেষ করলে না নরেন মল্লিক। সমীরের বাড়িতেই রাত্রে তারই ওখানে আহারাদির পর দুটো সোফার ওপরে মুখোমুখি বসে গল্প করছিল দুই বন্ধুতে।
আচমকা হঠাৎ একসময় সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল নরেন মল্লিক। ওয়ালক্লকটায় ঢং ঢং করে রাত্রি এগারটা ঘোষণা করলে।
উঃ, রাত অনেক হলো, চলি ভাই! Good Night।
.
এর দুদিন পর নরেন মল্লিকের বাড়িতে রাত্রে চোরের উপদ্রব হলো। আশ্চর্য, চোরের উপদ্রব হলো বটে কিন্তু কোন জিনিসই চুরি যায় নি শেষ পর্যন্ত দেখা গেল। নরেন ওই ডিস্ট্রিকটের পুলিস কমিশনার মিঃ চট্টরাজকে চোরের উপদ্রবের কথা সব বললে। চট্টরাজ নরেনের বন্ধু। দিবারাত্রির জন্য নরেনের গৃহে পুলিস প্রহরী মোতায়েন হলো। এবং আশ্চর্য, সঙ্গে সঙ্গে ছায়ামূর্তিও যেন মিলিয়ে গেল ছায়ার মতই।
তারপর দুমাস নির্বিঘ্নে কেটে গেল। আর কোন উৎপাত নেই—নরেনও ভুলে গেল বোধ হয় সব কথা। পুলিস প্রহরী উঠিয়ে নেওয়া হলো।
ঐ সময় সমীর স্বাস্থ্য খারাপ হওয়ায় মাস তিনেকের জন্য কলকাতার বাইরে যায়। নরেনের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ হবার সুযোগও হয় নি। যেদিন সমীর কলকাতায় ফিরে এলো তারই দিনতিনেক বাদে-নরেনের জন্মতিথি উৎসবে এলো সমীর নরেনের বাড়িতে। নরেনের আগের স্ফুর্তি যেন আবার ফিরে এসেছে, নরেন যেন অত্যন্ত খুশী!
সেই রাত্রেই অদৃশ্য আততায়ীর হাতে নৃশংসভাবে ছুরিকাঘাতে নিহত হলো নরেন মল্লিক।
চলন্ত গাড়ির মধ্যে রহমানের পার্শ্বে উপবিষ্ট কিরীটী মুখের পাইপটা হাতে নিয়ে একসময় প্রশ্ন করলে, নরেন মল্লিকের তাহলে একটা পূর্ব-ইতিহাস আছে বলুন-and quite interesting too! তারপর হঠাৎ আবার দ্বিতীয় প্রশ্ন করে, বাড়ির সমস্ত লোকেদের জবানবন্দীই তো নেওয়া হয়েছে, না মিঃ রহমান?
হ্যাঁ। এই যে দেখুন না, জবানবন্দীর ফাইলটা এই তো আমার সঙ্গেই আছে।
দেখি? হাত বাড়িয়ে কিরীটী রহমানের হাত থেকে জবানবন্দীর ফাইলটা নিল।
.
জবানবন্দী নেওয়া হচ্ছিল সেই দিন প্রাতে নরেন মল্লিকের শয়নকক্ষেই বসে। পার্ক সার্কাস থানা ইনচার্জ খোদাবক্স এক একজন করে ঘরের মধ্যে ডেকে এনে জবানবন্দী নিচ্ছেন। টেবিলের ওপরে ফাইলটা খোলা, হাতে পেনসিল, থানা ইনচার্জ খোদাবক্স জবানবন্দী লিখে নিচ্ছেন একের পর একের।