অপেক্ষমাণ এক-একটা প্রহর যেন এক এক যুগ বলে মনে হয়। তবু অপেক্ষা করেই থাকে কিরীটী-শেষ পর্যন্ত সে অপেক্ষা করবেই! এবং শেষ পর্যন্ত দীর্ঘ অপেক্ষার অবসান হলো। রাত যখন ঠিক চারটে বেজে দশ, গেট খুলে গেল এবং একাকিনী সেই চাদরে আবৃত মহিলা বের হয়ে এলেন।
কিরীটীও সঙ্গে সঙ্গে গাড়ি থেকে নেমে তাকে অনুসরণ করল। পায়ে ছিল তার পুরু রবার সোলের দামী জুতো। নিঃশব্দে অগ্রগামী মহিলাকে অনুসরণ করে সে চলল।
নির্জন রাস্তা। একেবারে খাঁ খাঁ করছে। সম্মুখে পশ্চাতে ডাইনে বাঁয়ে জনমানবের চিহ্ন পর্যন্ত নেই। শুধু রাত্রিশেষের অন্ধকারে এসেছে একটা দিকে অস্বচ্ছ আভাস। কিন্তু আর ওকে অগ্রসর হতে দেওয়া উচিত হবে না। এবারে একেবারে গলির মুখোমুখি এসে পড়েছে।
কিরীটী আচমকা তার চলার গতি অত্যন্ত দ্রুত করে অগ্রগামী মহিলাকে একেবারে ধরে ফেললে এবং ডাকলে, বিনতা দেবী দাঁড়ান!
চকিতে ভদ্রমহিলা কিরীটীর সেই ডাক শুনে ঘুরে দাঁড়ালেন।
বিনতা দেবী!
সুস্পষ্ট নারীকণ্ঠে এবারে জবাব এলো, আপনি কি আমাকে কিছু বলছেন?
হাঁ।
আপনি বোধ হয় ভুল করেছেন।
ভুল করেছি!
হাঁ। আমার নাম বিনতা নয়। সুস্পষ্ট প্রত্যুত্তর, কোন সংশয় বা জড়তা মাত্রও নেই কণ্ঠস্বরে।
না, আমি ভুল করি নি। তবে বিনতা দেবী ছাড়াও আপনার অন্য কোন যদি নাম থাকে তো বলতে পারি না। কিন্তু সে কথা থাক। আপনার সঙ্গে আমার কিছু কথা ছিল যে—
আমার সঙ্গে! কিন্তু আপনাকে চেনা তো দূরে থাক, কখনো দেখেছি বলেও তো মনে পড়ছে না আমার। বলতে বলতে হঠাৎই যেন মহিলা তার মুখের উপরের অনতিদীর্ঘ অবগুণ্ঠনটা বাঁ হাত দিয়ে টেনে একেবারে কপালের উপরে তুলে দিলেন।
গলির ঠিক মুখেই একটা গ্যাসপোস্ট ছিল, অবগুণ্ঠন উন্মোচিত মুখখানির ওপর চকিতে সেই আলো এসে পড়ল। এবং সঙ্গে সঙ্গে একটা চাপা আর্ত শব্দ কিরীটীর অজ্ঞাতসারেই তার কণ্ঠ দিয়ে বের হয়ে আসে। কোন জীবিত মানুষের মুখ যে এত ভয়াবহ, এত কুৎসিত হতে পারে এ যেন কিরীটীর চিন্তারও অতীত ছিল।
শুধু ভয়াবহ ও কুৎসিত বললেই হয়ত সবটুকু তার বলা হয় না, বিকৃত একটা দুঃস্বপ্ন। যেন! আগুন বা তীব্র অ্যাসিড জাতীয় কিছুতে পুড়ে গেলে বিশ্রীভাবে যা দাঁড়ায় ঠিক তাই।
মুখের রেখা বা গঠনটাই আছে শুধু। নাক চোখ মুখ ওষ্ঠ জ্বর কোনটারই চিহ্নমাত্রও নেই বললেও অত্যুক্তি হয় না। একটা চোখ আছে, দ্বিতীয়টা নেই।
যার হাঁটা, দেহের গঠন, হাত এবং পায়ের রং দেখে একদা কিরীটীর মনে হয়েছিল কতই না সুন্দরী মহিলা, তার অবগুণ্ঠনের তলায় যে এত বড় একটা ভয়াবহ বিভীষিকা ঢাকা থাকতে পারে বুঝি সে কল্পনাও করে নি।
বিস্ময়ের ঘোরটা কেটে যাবার পর কিরীটীর স্বাভাবিক অবস্থাটা যখন ফিরে এলো দেখলো অবগুণ্ঠিতা মহিলা ধীরে ধীরে সামনের গলির মধ্যে মিলিয়ে যাচ্ছেন।
নির্বাক কিরীটী দাঁড়িয়ে রইলো। একটি শব্দও আর তার ওষ্ঠপ্রান্তে জাগল না। ফিরে এলো যখন কিরীটী, গাড়ির দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে চন্দ্রনাথ।
কি হলো স্যার?
বিশেষ তেমন কোন সুবিধা করতে পারলাম না চন্দ্রনাথ। গাড়িতে উঠে বসে স্টার্ট দিতে দিতে কথাটা মৃদু কণ্ঠে বললে কিরীটী।
আমি কি এখনো যেভাবে ফ্ল্যাটটার দিকে নজর রাখছিলাম রাখব?
হ্যাঁ।
ঐদিন সন্ধ্যার ঠিক মুখে। টেলিফোন অফিস। অপারেটিং রুমে অপারেটাররা যে যার মাথায় হেডপিস লাগিয়ে কাজে ব্যস্ত।
হঠাৎ এক সময় কৃষ্ণা উঠে দাঁড়ায়, তার রিলিফ এসে গিয়েছে সুধীরা নাগ।
রিলিফের হাতে কার্যভার তুলে দিয়ে কৃষ্ণা কাবেরীর দিকে ফিরে তাকিয়ে বললে, আমার duty off হলো, আমি চললাম কাবি, তোর তো দশটা পর্যন্ত ডিউটি আছে, না?
হাঁ। কৃষ্ণা অপারেটিং রুম থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে গেল।
অপারেটিং রুমে কাজ চলেছে, মধ্যে মধ্যে অপারেটাররা নানা আলাপ-আলোচনা, হাসিতামাশাও করছে।
নবনিযুক্ত দুটি মেয়ে ইতিমধ্যে পরস্পরের মধ্যে নিজেদের ব্যক্তিগত আলোচনা নিয়ে মেতে উঠেছে।
একজনের নাম মিস লীলা ঘোষ, অন্যটির নাম মিস সবিতা চ্যাটার্জী। আরো দুচারজনও সেখানে এসে আড্ডায় যোগ দিয়েছে।
লীলা—জানিস ভাই সাবি, হিমাংশুটা একটা আসল ন্যাকা, কেবল শুনতে চাইবে তাকে আমি ভালবাসি কিনা?
সবিতা-বললেই পারিস, বাসি না।
লীলা—ওরে বাবা! তাহলে রক্ষে আছে? বলবে পটাসিয়াম সায়ানাইড় খাবো।
মিস ঘোষ স্থূলকায়া, বয়সও প্রায় চল্লিশের কাছাকাছি, এগিয়ে এসে বলে, অমন ঢের বীরই সায়ানাইড় খেয়ে থাকে, এই তো সবে শুরু, বলে কত দেখলাম!
নীরা মল্লিক বলে ওঠে, বলুন না মিস ঘোষ, আপনার সেই fifty second লাভারের কথাটা!
ওদিকে বোর্ডে তখন ঘন ঘন ক আসছে, শ্ৰীমতীদের সেদিকে কারো কিন্তু এতটুকু খেয়াল নেই।
মিস ঘোষ কানেকশনটা দিয়ে বলে, Number please?
ওধার থেকে জবাব আসে, কতক্ষণ ধরে তো বলছি, B. B. 4542-শুনতে পান না নাকি?
মিস ঘোষ কানেকশনটা কেটে আবার আলাপে রত হয়, সে এক মজার ব্যাপার! সে ছেলেটি এক ইনসিওরেন্স অফিসে ১০০ টাকা না কত মাইনের যেন কাজ করতো–
বোর্ডে আবার আলো জ্বলে ওঠে, কল্ এসেছে।
পাশের থেকে একজন অপারেটার বলে ওঠে, আঃ জ্বালাতন! বলুন না মিস ঘোষ এনগেজড!
মিস ঘোষ আবার কনেকশনটা দিয়ে বলে, Number please!
Please put me B. B….