বড় রাস্তাটার একদিকে ফ্ল্যাট বাড়িটা এবং ঠিক তার উল্টোদিকে ডিলুক্স রেস্তোরা। সন্ধ্যা সবে তখন উত্তীর্ণ হয়েছে। শীতের সন্ধ্যা। রেস্টুরেন্ট ইতিমধ্যেই চা-পিয়াসীদের ভিড়ে সরগরম হয়ে উঠেছে।
রেস্টুরেন্ট থেকে অল্প দূরে গাড়িটা পার্ক করে মন্থর পদে এগিয়ে চলল কিরীটী রেস্টুরেন্টের দিকে। মাঝারি গোছের একটি ঘরের মধ্যে রেস্টুরেন্ট। ভিতরের খরিদ্দারের ভিড় দেখে বোঝা যায় বিক্রিপত্র ভালই। ঘরের মাঝখানে গোটাচারেক টেবিল পেতে খদ্দেরদের বসাবার জন্য স্টীলের চেয়ার পাতা আর দেওয়ালের ধার ঘেঁষেও ব্যবস্থা আছে। দেওয়ালের চারদিকে চারটে ফ্লোরেসেন্ট টিউব জ্বলছে। কাউন্টারের একপাশে রেডিও সেটে শোনা যাচ্ছে পল্লীমঙ্গল আসর জমে উঠেছে। ঘরের বাতাসে পিঁয়াজ রসুন ও মাংস ভাজার একটা লোভনীয় মিশ্র গন্ধ।
ভিতরে প্রবেশ করে কিরীটী একবার চারদিকে তাকাতেই দৃষ্টিটা তার উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। দক্ষিণ কোণে মুসলমান বেশভূষায় মাথায় একটা শালের টুপী ২৫/২৬ বছরের একটি যুবক একাকী বসে চা-পান করছিল। কিন্তু চা-পানের চাইতেও তার মনোযোগ ছিল বেশী রাস্তার ঠিক অপর পারে কৃষ্ণাদের ফ্ল্যাটের মেইন দরজাটার দিকে। কারণ সেখান থেকে স্পষ্ট সব কিছু দেখা যায়।
কিরীটী এগিয়ে গিয়ে তার টেবিলেই একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসল।
রেস্টুরেন্টের একটি ছোকরা এগিয়ে এলো, কি দোব?
এক কাপ স্ট্রং করে চা দাও। ছোকরাটি চলে যেতেই চাপা গলায় কিরীটী তার সামনে উপবিষ্ট মুসলমান-বেশ-পরিহিত লোকটিকে সম্বোধন করে বলল, চন্দ্রনাথ খবর কি?
খবর আছে, স্যার। চা-টা খেয়ে সামনের পার্কে আসুন। আমি সেখানেই অপেক্ষা করছি। চন্দ্রনাথের চা-পান হয়ে গিয়েছিল। উঠে গিয়ে কাউন্টারের দাম মিটিয়ে দিয়ে বের হয়ে গেল।
মিনিট পাঁচেক বাদে কিরীটীও রেস্টুরেন্ট থেকে বের হলো। বড় রাস্তাটা ধরে একটু এগুলেই বাঁ-হাতে একটা ছোট ত্রিকোণা পার্ক। একটা সিগারে অগ্নিসংযোগ করে ধূমপান করতে করতে কিরীটী সেই পার্কের মধ্যে প্রবেশ করল।
কিরীটী এদিক ওদিক তাকাতে লাগলো চন্দ্রনাথের সন্ধানে।
হঠাৎ তার নজর পড়ল চন্দ্রনাথ তারই দিকে এগিয়ে আসছে।
আরো কাছে এসে চন্দ্রনাথ বললে, চলুন স্যার, ঐ বেঞ্চটায় গিয়ে বসা যাক।
বেঞ্চে তখন আর কোন তৃতীয় ব্যক্তি ছিল না। দুজনে পাশাপাশি বসল।
আপনার কাছে কালই আমি যেতাম আপনি না এলে। গত চার-পাঁচদিন ধরেই লক্ষ্য করছিলাম রাত এগারটার পর একটি রিকশা ঠুং ঠুং করে ঐ ফ্ল্যাট বাড়ির গেটের সামনে এসে দাঁড়ায়। তারপর সর্বাঙ্গ চাদরে মোড়া ঘোমটা টানা একটি ভদ্রমহিলা রিকশা থেকে নেমে ঐ ফ্ল্যাট বাড়িটার মধ্যে প্রবেশ করেন এবং কিছুক্ষণ বাদে আবার বের হয়ে যান। কিন্তু কাল রাত্রে–
কি?
ভদ্রমহিলাকে গতকাল রাত্রে আমি ফলো করেছিলাম।
করেছিলে?
হাঁ। ফ্ল্যাটের মধ্যে ঢোকবার পর আমিও কিছুক্ষণ পরে ফ্ল্যাটটার মধ্যে গিয়ে ঢুকলাম।
তারপর?
দেখলাম সোজা তিনি কৃষ্ণা দেবীদের ফ্ল্যাটের দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে বদ্ধ দরজার গায়ে আঙুল দিয়ে আস্তে আস্তে তিনটি টোকা দিতেই একটু পরে কৃষ্ণা বা কাবেরী দুজনার মধ্যে একজন এসে দরজা খুলে দিলেন। তিনি ভিতরে প্রবেশ করলেন এবং সঙ্গে সঙ্গেই ভিতর থেকে দরজাটা আবার বন্ধ হয়ে গেল।
তার পর কি হলো?
তা ঠিক বলতে পারব না, কারণ রাত দুটো পর্যন্ত অপেক্ষা করেও যখন দেখলাম ভদ্রমহিলা আর ফ্ল্যাট থেকে বের হয়ে এলেন না, আমি ফিরে গেলাম।
হুঁ! কিরীটীর হৃদুটো কুঞ্চিত হয়ে ওঠে।
তাই আজ ভাবছিলাম, আজও যদি তিনি আসেন তো আবার তাঁকে ফলো করবো ও শেষ পর্যন্ত তাঁর জন্য অপেক্ষা করবো।
কিন্তু হয়তো আর তিনি ও-বাড়ি থেকে না-ও বের হতে পারেন।
আপনি বলছেন গত রাত্রে সেই যে তিনি ঢুকেছেন আর বের হন নি!
হাঁ।
হতে পারে। তবু দেখবো।
বেশ। তুমি অপেক্ষা করো। আমিও রাত্রে একবার আসবো।
আসবেন?
হ্যাঁ।
নির্দিষ্ট সময়ের কিছু পূর্বেই কিরীটী এসে হাজির হলো এবং বাড়িটা থেকে কিছু দূরে একটা গাছের নীচে অন্ধকারে গাড়িটা পার্ক করে সব আলো নিবিয়ে অপেক্ষায় রইলো। চন্দ্রনাথ পিছনের সীটে বসে রইলো। কিন্তু রাত তিনটে পর্যন্ত অপেক্ষা করেও কোন রিকশা বা অবগুণ্ঠনবতী মহিলার দেখা পাওয়া গেল না। এবং রাত বারোটা নাগাদ ফ্ল্যাটের মেইন দরজা বন্ধ হয়ে গেল।
কিন্তু কিরীটী এক রাত্রের বিফলতাতেই হতাশ হলো না। পরের রাত্রেও তেমনি অপেক্ষা করল। এবং সে-রাত্রিও নিম্ফলেই গেল।
দেখা মিলল তৃতীয় রাত্রে।
রাত বারোটায় ঠিক গেট বন্ধ হয়ে গেল। এবং রাত যখন একটা হবে, কিরীটীর একটু ঝিম মত এসেছে, পিছন থেকে পৃষ্ঠদেশে একটা মৃদু ধাক্কা খেয়ে সে সচকিত হয়ে উঠল।
এসেছে, স্যার!
অদূরে গীর্জার ঘড়িতে ঢং করে রাত্রি একটা ঘোষিত হলো।
কিরীটী তাকিয়ে দেখলো সর্বাঙ্গে একটা সাদা চাদর আবৃত একটি ভদ্রমহিলা নিঃশব্দ পদসঞ্চারে এগিয়ে আসছেন। মেইন গেটটার সামনে এসে দাঁড়াবার কিছুক্ষণ পরেই হঠাৎ গেটটা খুলে গেল। খোলা গেটের উপরে রাস্তায় লাইটপোস্টের আলোটার খানিকটা অংশ গিয়ে পড়েছে। এবং সেই আলোতেই দেখা গেল, খোলা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কৃষ্ণা কাবেরীর এক বোন।
আগন্তুক ভদ্রমহিলা ভিতরে প্রবেশ করলেন এবং সঙ্গে সঙ্গে গেটের কপাট দুটো বন্ধ হয়ে গেল।