সঞ্জীবের কথায় চকিতে ফিরে দাঁড়াল কিরীটী। সঞ্জীবের চোখের দৃষ্টিও কিরীটীর উপরে নিবদ্ধ, পাথরের মত স্থির দৃষ্টি, সমস্ত মুখের রেখায় যেন একটা সুকঠিন তাচ্ছিল্য সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
শুনুন মিঃ সি. আই. ডি. যে মুহূর্তে আপনি ঘরে এসে ঢুকেছেন আপনার আসল ইচ্ছাটা আমার কাছে আর অস্পষ্ট থাকে নি। আমি জানি কি জন্য আপনি এ সময় আমার বাড়িতে হানা দিয়েছেন। আপনি কেন, এ দুনিয়ায় কারো সাধ্য নেই একবার সঞ্জীব চৌধুরীর হাতে মুঠোর মধ্যে যা আসে তাকে ছিনিয়ে নিতে পারে। যাক সে কথা, আশা করি আপনার যা জানবার ছিল আপনি জেনেছেন।
কিরীটীর চোখে মুখে অদ্ভুত একটা হাসি ফুটে ওঠে, বুঝলাম, কিন্তু যাবার আগে আমি একটা জিনিস মাত্র আপনার এখান হতে নিয়ে যাবো–
কি? বিস্ময়-বিস্ফারিত চোখে তাকান সঞ্জীব কিরীটীর মুখের দিকে।
বিশেষ তেমন অবিশ্যি কিছুই নয়—আপনার হাতের ঐ বইটি—
এই বইটা! ফ্যালফ্যাল করে তাকান সঞ্জীব কিরীটীর মুখের দিকে।
হাঁ। বলেই মুহূর্তে যেন ছোঁ মেরে কিরীটী সঞ্জীবের কোলের উপর রক্ষিত বইটা তুলে নেয় এবং তাকে দ্বিতীয় বাক্যব্যয়ের অবকাশমাত্র না দিয়ে বলে ওঠে, যা আমি এখানে খুঁজতে এসেছিলাম পেয়েছি মিঃ চৌধুরী। ধন্যবাদ। আচ্ছা good bye!
কিরীটী তড়িৎ-পদে কক্ষ ত্যাগ করে চলে গেল।
সঞ্জীব চৌধুরী কতকটা যেন বোকা বনে গিয়েছেন এমনি ভাবে কিরীটীর গমনপথের দিকে তাকিয়ে থাকেন কিছুক্ষণ।
.
কিরীটীর বসবার কক্ষ। একা একা তালুকদার বসে বসে খানকয়েক চিঠি একটার পর একটা পড়ে যাচ্ছিল। কিরীটী এসে কক্ষে প্রবেশ করল।
আরে তালুকদার যে, কতক্ষণ?
তা আধ ঘণ্টাটাক তো হবেই—এই যে এই চিঠিগুলো নরেন মল্লিকের শয়নকক্ষের একটা আলমারির গুপ্ত ড্রয়ার থেকে উদ্ধার করা হয়েছে।
কিরীটী সঞ্জীব চৌধুরীর ঘর হতে আনীত মোটা বইখানা পাশের টেবিলের উপরে রেখে একটা সোফার উপরে গা এলিয়ে দিতে দিতে বললে, প্রেমপত্র নিশ্চয়?
হুঁ।
প্রেমিকাটি কে?
সেটাই তো বুঝে উঠতে পারছি না।
কি রকম?
এই দেখো না—এগিয়ে দিল তালুকদার চিঠিগুলো ও খামগুলো কিরীটীর দিকে।
চিঠি ও খামগুলো উল্টে-পাল্টে দেখে কিরীটী মৃদু কণ্ঠে বললে, হুঁ, এখানেও অগাধ জল। প্রত্যেকটা চিঠির মধ্যেই দেখছি সম্বোধন করা হয়েছে প্রিয়া আমার প্রিয়তম বলে আর চিঠির নিচে নাম স্বাক্ষর করা হয়েছে ইতি তোমার ক বলে। ক অর্থাৎ কৃষ্ণাও হতে পারে। কাবেরীও হতে পারে। এদিকে আমি যে চিঠিগুলো উদ্ধার করে এইমাত্র আনলাম তাতেও দেখলাম লেখা আছে, প্রিয়তম আমার সম্বোধনে, আর ইতি করা হয়েছে তোমার প্রিয় ‘ন’ বলে। Again that blessed কৃষ্ণা কাবেরীর puzzle!
যা বলেছে, যে দিকে যাই ঐ কৃষ্ণা কাবেরী যেন পথরোধ করে দণ্ডায়মান–
কিন্তু যেমন করে হোক কৃষ্ণা কাবেরী রহস্য আমাদের সমাধান করতেই হবে। শেষের দিকে কিরীটীর কণ্ঠে যেন একটা দৃঢ় প্রতিজ্ঞার সুর ঝঙ্কৃত হয়ে ওঠে।
রায়, এবারে দেখছি সত্যিই তোমায় হার মানতে হলো!
হার মানতে হলল! সিংহের মত গ্রীবা বেঁকিয়ে, কেশর ফুলিয়ে কিরীটী যেন সহসা সোজা হয়ে বসে, আমিও কিরীটী রায়, তালুকদার।
কিরীটীর চোখে, মুখে, সর্বদেহে এবং কণ্ঠস্বরে পর্যন্ত একটা ঋজু কাঠিন্য যেন ইস্পাতের মতই ঝিকিয়ে ওঠে।
হঠাৎ কিরীটী সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। এবার জাল গুটাবো। এগিয়ে গিয়ে কিরীটী ফোনের মাউথ-পিষ্টা তুলে নেয়। হালো! Put me to P. K. …Please!
কে, ডাক্তার? আমি কিরীটী।
হাঁ। কি সংবাদ?
শোন—
.
মধুর কাছে অনুসন্ধান করতেই কিরীটী বিনতা দেবীর একটা সন্ধান পেয়ে গেল। কলকাতা ছেড়ে বিনতা দেবী আপাততঃ যান নি। পার্ক সার্কাসের কাছে একটা অখ্যাতনামা গলির মধ্যে একটা ঘর নিয়ে আছেন। মধু সেখানে মধ্যে মধ্যে যায়। বেচারী মধু তাকে সত্যিই ভালবেসেছিল। তাই আজও তার মায়াটা কাটিয়ে উঠতে পারে নি। মধ্যে মধ্যে সেখানে গিয়ে তার বাজারটা-আসটা করে দিয়ে আসে। মধু গলির নাম বা বাড়ির নম্বরটা বলতে পারল না, কিন্তু দূর থেকে কিরীটীকে দেখিয়ে দিল।
হঠাৎ মধু একটা প্রশ্ন করে কিরীটীকে, বিনতা মাকে আপনার কি দরকার বাবু? তার এত খবর নিচ্ছেন কেন এত করে?
তোমার বাবুর চাকরি তো ছেড়ে দিলেন, তাই ভাবছিলাম যদি ওঁর অন্য কোথাও একটা ভাল ব্যবস্থা করে দিতে পারি!
আহা, তা যদি পারেন তো তার বড় উপকার হয়। মা আমার বড় ভাল।
তা সুবিমলবাবু তো শুনলাম ওঁকে চাকরি থেকে ছাড়াতে চান নি, তবে উনি চাকরি ছেড়ে দিলেন কেন মধু?
কি জানি বাবু, সেটাই তো বুঝতে পারলাম না। তবে আমার মনে হয় ভয়ে।
ভয়ে! কিসের ভয়ে?
মধু এবার যেন একটু ইতস্ততঃ করতে থাকে।
কিরীটী আবার প্রশ্ন করে, কি ব্যাপার বল তো?
বাড়িটার মধ্যে বাবু মারা যাবার পর থেকেই কেমন যেন সব শব্দ শোনা যায়—
বল কি!
হাঁ বাবু, আর আর যারা সব আছে তারাও ইতিমধ্যে পালাই পালাই শুরু করেছে।
শব্দ! কি রকম শব্দ বল তো?
সে বাবু নানা রকমের শব্দ!
কিরীটীর ইচ্ছা ছিল কথাপ্রসঙ্গে মধুর ক্ষণপূর্বের বিনতা সম্পর্কে কৌতূহলের চিন্তাধারাটা একটু ঘুরিয়ে দেবে। কথাপ্রসঙ্গে সেটা আপনা থেকেই হয়ে যেতে কিরীটী যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল।
মধুর সঙ্গে আরো কিছুক্ষণ আলাপ করে তাকে বিদায় দিয়ে কিরীটী অন্য পথ ধরলো। পার্ক সার্কাস অর্থাৎ এ অঞ্চলেই কৃষ্ণা ও কাবেরীদের ওপর সর্বদা নজর রাখবার জন্য সে নিজের যে লোকটিকে নিযুক্ত করেছিল, ভাবল তার সঙ্গে একবার দেখা করে যাবে যখন এ অঞ্চলেই এসেছে। কৃষ্ণা কাবেরীদের ফ্ল্যাটটা সেখান থেকে বেশী দূরেও নয়।