ডাইরীটা পড়বার পর থেকে এবং তালুকদারের মুখে নরেন মল্লিক সম্পর্কে আরো কিছুটা নতুন তত্ত্ব শুনে তার মনের চিন্তাধারাটা যেন সম্পূর্ণ একটি ভিন্ন পথে বইতে শুরু করেছে। এবং এতক্ষণে যেন সমস্ত ঘটনাগুলোকে নতুন করে পর পর সাজিয়ে নির্দিষ্ট একটি আকারে পৌঁছবার সম্ভাবনা দেখতে পেয়েছে। কৃষ্ণা ও কাবেরীর ফ্ল্যাটটা সার্চ করবার চাইতেও খোঁড়া সঞ্জীব চৌধুরীর সঙ্গে আলাপ করবার ইচ্ছাটাই কিরীটীর প্রাণে প্রবল হয়ে উঠছিল। খোঁড়া অর্থাৎ বিকলাঙ্গ হয়েও মেয়েদের প্রতি তার অদ্ভুত একটা আধিপত্য, বিশেষ করে তারা অপরূপ সুন্দরী, শিক্ষিতা ও উপার্জনশীল হওয়া সত্ত্বেও, যা এ যুগের মেয়েদের মধ্যে বড় একটা দেখাই যায় না এবং শুধু আধিপত্যই নয়, বাপের অমতে চলবার কৃষ্ণা বা কাবেরীর কারোই সাহস নেই। বাঘিনী যেমন বাচ্ছাদের আগলে রাখে সর্বদা তেমনি করেই খোঁড়া সঞ্জীব চৌধুরী তার মেয়ে কৃষ্ণা ও কাবেরীকে আগলে রেখেছে।
কিন্তু কেন এ সতর্কতা!
এর মূলে কোন সন্দেহ বা কোন রকম কমপ্লেকস্ সঞ্জীবেরই। আর মেয়েরাই বা বাপকে অত ভয় করে চলে কেন? কলকাতা ছেড়ে হঠাৎ মেয়েদের নিয়ে চলে যাবার পর দীর্ঘ পনের বছরের সঞ্জীব চৌধুরীর ইতিহাসটা আজো জানা যায় নি। দীর্ঘ পনের বছর এক আধ দিনও নয়। একটা যুগ। দীর্ঘ পনের বছর। হঠাৎ যেন বিদ্যুৎচমকের মতই একটা সম্ভাবনা কিরীটীর মনের মধ্যে উঁকি দেয়।
কি আশ্চর্য! আশ্চর্য, সেও ঠিক পনের বছর! সঙ্গে সঙ্গে কিরীটীর কপালের কুঞ্চিত রেখাগুলো সরল হয়ে আসে। আনন্দে চোখের তারা দুটো চক্ চক্ করে ওঠে। আর দেরি নয়, কালই যেতে হবে তাকে সঞ্জীব চৌধুরীর ওখানে। কিরীটী উঠে গিয়ে ফোনের রিসিভারটা তুলে নিল। ডাক্তারই তাকে ঠিক সংবাদ দিতে পারবে। এবং যেতে হবে তাকে কৃষ্ণা ও কাবেরীর অনুপস্থিতিতে।
বেলা তখন ঠিক দ্বিপ্রহর। কিরীটী আগে হতেই সংবাদ নিয়ে জেনেছিল ঐদিন দ্বিপ্রহরে দুটি বোনেরই অফিসে ডিউটি আছে, দুজনের একজনও দ্বিপ্রহরে বাড়ি থাকবে না। আসবার পথে কিরীটী পার্ক সার্কাস থানা ইনচার্জ খোদাবক্সের কাছ থেকে দুজন লাল পাগড়ী সঙ্গে করে নিয়ে এল।
সোজা উপরে উঠে এসে কিরীটী দরজার কলিং বেল টিপতেই একটু বাদে একটি বৃদ্ধা গোছের ঝি এসে দরজা খুলে দিল।
কাকে চান বাবু?
মিঃ চৌধুরী, মানে বুড়ো বাবু বাড়িতে আছেন?
আছেন, কিন্তু তিনি কারো সঙ্গেই দেখা করেন না বাবু।
তুমি বুঝি এ বাড়িতে চাকরি করো, কি নাম তোমার?
আজ্ঞে সরলা।
দিনরাতের?
আজ্ঞে বাবু না, ঠিকে কাজ করি।
আমার বড্ড জরুরী দরকার, একটিবার বাবুর সঙ্গে দেখা না করলে চলবেই না। তুমি গিয়ে বাবুকে বরং একবার—
ঝি ভীত, শঙ্কিত ভাবে বলে ওঠে, ওরে বাবা! তাঁর কাছে কে যাবে বাবু? কদিন থেকে কর্তাবাবুর যা মেজাজ হয়ে আছে, আর তা ছাড়া বাবুর ঘরে ঢুকবারও আমার হুকুম নেই–
এমন সময় হঠাৎ ভিতর থেকে গম্ভীর গলায় কে যেন প্রশ্ন করল, কে? একটা খট্ খট্ শব্দও শোনা গেল ঐ সঙ্গে।
খট খট খট! …শব্দটা ক্রমেই এগিয়ে আসছে।
একটু পরেই ভিতর ও বাইরের মধ্যবর্তী দরজার উপরে দেখা গেল সঞ্জীব চৌধুরী ক্রাচে ভর দিয়ে এসে দাঁড়িয়েছেন।
তীক্ষ্ণ, অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টিতে কিরীটীর মুখের দিকে তাকিয়ে সঞ্জীব প্রশ্ন করলেন, কে আপনি, এখানে কি চান?
কিরীটী বিনম্র কণ্ঠে বললে, এখানকার ইনটেলিজেন্স ব্রাঞ্চের এইচ. কিউ. থেকে আসছি, আমার নাম ধূর্জটি রায়।
ওঃ। তা এখানে আপনার কি প্রয়োজন?
আপনিই কি মিঃ সঞ্জীব চৌধুরী?
হাঁ।
তা দেখুন, প্রয়োজন বিশেষ একটা আছে বৈকি। কিন্তু সেটা তো এভাবে এইখানে দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে বলা চলে না।
ওঃ। আসুন তাহলে ভিতরে।
কিরীটী কমধ্যে এসে প্রবেশ করল।—বসতে পারি?
বসুন।
কিরীটী একটা সোফার উপরে উপবেশন করল।
বলুন কি চান আপনি?
আপনার বাড়িটা একবার সার্চ করতে চাই—
সার্চ করতে চান, মানে?
হ্যাঁ, বিশ্বস্ত সূত্রে আমাদের অফিস অবগত হয়েছে, আপনার বাড়িতে নাকি কতকগুলো জরুরী পলিটিক্যাল ডকুমেন্টস্ লুকানো আছে—
ভ্রূ কুঞ্চিত করে তীক্ষ্ণ, অনুসন্ধানী দৃষ্টিতে সঞ্জীব চৌধুরী কিরীটীর দিকে বারকয়েক তাকালেন, কি বললেন পলিটিক্যাল ডকুমেন্টস্?
আজ্ঞে।
কিছুক্ষণ ক্রাচে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে সঞ্জীব যেন কি ভাবলেন, পরে গম্ভীর নিরুৎসুক কণ্ঠে বললেন, বেশ, আসুন। দেখুন খুঁজে।
কিরীটী প্রথমেই কৃষ্ণা কাবেরীর ঘরটা তন্ন তন্ন করে অনুসন্ধান করা শুরু করলে।
কিরীটীকে এই ঘরে পৌঁছে দিয়ে সঞ্জীব তার নিজের কক্ষে গিয়ে চেয়ারটার উপরে একটা বই খুলে নিয়ে বসলেন। কিরীটী কিন্তু কিছু তেমন খুঁজে পেল না কৃষ্ণা কাবেরীর ঘরে।
এ ঘরের যা কিছু দেখবার দেখে কিরীটী সঞ্জীবের কক্ষে এসে প্রবেশ করলো।
সঞ্জীব বই হতে মুখ না তুলেই প্রশ্ন করলেন, কি চাই?
আপনার ঘরটাও একবার দেখতে চাই, যদি কিছু মনে না করেন!
দেখুন—স্বচ্ছন্দে।
কথাটা বলে সঞ্জীব যেমন বই পড়ছিলেন তেমনি বই পড়তে লাগলেন।
কিরীটী বিনা বাক্যব্যয়ে তার অনুসন্ধান শুরু করে দিল।
প্রথমেই বইয়ের আলমারি ও অন্যান্য ড্রয়ার ও ডেস্কগুলো তন্ন তন্ন করে পরীক্ষা করেও কিরীটী তার অভীপ্সিত বস্তু খুঁজে পেল না।
কি হলো, কিছু পেলেন?
অ্যাঁ! কি বললেন?
বলছিলাম, পেলেন খুঁজে সেই পরশ পাথরটি—that valuable document of your most Honourable the ইংরাজ সরকার বাহাদুরের?