অর্থাৎ?
অর্থাৎ আমি বলতে চাই নরেন মল্লিকের হত্যার ব্যাপারটা আকস্মিক নয় বা আচমকাও নয়। তার হত্যার বীজ রোপিত হয়েছিল অনেক অনেক দিন আগে। হত্যালিপ্সা মনের মধ্যে পোষণ করে হত্যাকারী সুযোগ ও সময়ের অপেক্ষায় ছিল মাত্র এবং তারই যোগাযোগ হচ্ছে হত্যার ব্যাপারটা। অবিশ্যি যোগাযযাগটা পরে ঘটনাচক্রে বা আকস্মিকও হতে পারে। হত্যাকারীকে আমাদের খুঁজে বের করতে হলে যে উপায়েই হোক আমাদের ফিরে যেতে হবে নরেন মল্লিকের অতীত জীবনে। যেখানে ঘটনাচক্রে রোপিত হয়েছিল সেদিন হত্যার বীজ। তাই তো বলছিলাম, শুধু নরেন মল্লিকের গৃহই আর একবার ভাল করে খুঁজে দেখা নয়, কলকাতায় আসবার আগে যেখানে সে ছিল সেখানকার ইতিহাসও তো কম দিনের নয় নেহাৎ। সেটাও যথাসম্ভব অনুসন্ধান করে দেখতে হবে এবং কলকাতা ছেড়ে বর্মায় গিয়ে ব্যবসা ফঁদবার আগেকার দিনের ইতিহাসটাও আমাদের সাধ্যমত সংগ্রহ করতে হবে। এমনি সে কলকাতা ছেড়ে ভাগ্যান্বেষণে বর্মায় গিয়েছিল, না অন্য কোনভাবে নিরুপায় হয়ে সে স্থানত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিল!
সে সংবাদটা সংগ্রহ করা হয় বিশেষ কষ্টসাধ্য হবে না। রহমান সাহেব বলেন।
দুজনের মধ্যে যখন কথা হচ্ছে তালুকদার এসে ঘরে প্রবেশ করল।
এসো তালুকদার, কি খবর? কিরীটী আহ্বান জানাল।
নরেন মল্লিকের হত্যারহস্যের কোন কিনারা করতে পারলে রায়?
এতক্ষণ ধরে রহমান সাহেবের সঙ্গে সেই আলোচনাই করছিলাম।
কিন্তু কদিন তোমার কোন পাত্তাই ছিল না, ব্যাপার কি?
আর ভাই বল কেন? একটা রেলওয়ে ডাকাতির ব্যাপারে তদন্তে এলাহাবাদ পর্যন্ত ছুটতে হয়েছিল। আজ সকালেই ফিরেছি। অফিসে এসে ভাবলাম যাই তোমার সঙ্গে একবার দেখা করে আসি। যদি কোন নতুন ডেভেলপমেন্ট হয়ে থাকে।
অন্ধকারে ক্ষীণ একটা আলোর শিখা ধরতে পেরেছি। মনে হচ্ছে এবারে হয়ত কিছুটা আরো এগুনো যাবে।
কথাটা শুনে তালুকদার সাহেব উৎসাহিত হয়ে ওঠে, বলে, বটে!
হ্যাঁ, মধুর কাছ থেকে মৃত নরেন মল্লিকের একটা ডাইরী পাওয়া গিয়েছে।
সংক্ষেপে কিরীটী অতঃপর তালুকদারকে ডাইরীর ব্যাপারটা বলে যায়। এবং এও বলে ঐ সঙ্গে, তাই বলছিলাম রহমান সাহেবকে নরেন মল্লিকের অতীত জীবনের ইতিহাসটা যতটা সম্ভব খুঁজে বের করবার জন্য।
সমীরবাবুর কাছে ছাড়াও নরেন মল্লিকের কলকাতা ত্যাগ করে বর্মা যাবার পূর্বের ইতিহাস কিছু কিছু আমি সংগ্রহ করেছিলাম।
করেছিলে নাকি! কই এ কথা তো আমাকে জানাও নি!
হঠাৎ এলাহাবাদ চলে যেতে হলো তাই জানাতে পারি নি, তালুকদার বললে।
কেমন করে কার কাছ থেকে শুনলে?
সেও এক আশ্চর্য ব্যাপার।
কি রকম?
আমার বন্ধু ব্যারিস্টার অমল ঘোষকে তো তুমি চেন?
না চিনি না, তবে নাম শুনেছি তাঁর—ভা প্র্যাকটিস।
এলাহাবাদ যাবার আগের দিন তার বাড়িতে একটা কাজে যেতে হয়েছিল আমাকে। সেখানেই সে কথায় কথায় আমাকে বলে নরেন মল্লিককে নাকি সে চিনত, একই সঙ্গে বিলেত থেকে তারা একই বছরে ব্যারিস্টার হয়।
সত্যি?
হ্যাঁ।
তারপর?
কলকাতায় ফিরে এসে অমলের সঙ্গেই প্র্যাকটিস শুরু করে। তবে বাপের কিছু পয়সা থাকায় প্র্যাকটিস্ জমানোর চাইতে স্ফূর্তির দিকেই তার নজর ছিল। একদল সোসাইটি মেয়ে পুরুষের সঙ্গে আজ পার্টি, কাল পিকনিক, পরশু চ্যারিটি শো এই সব নিয়েই থাকত। এমন সময় তার বাপ হঠাৎ মারা গেলেন সন্ন্যাস রোগে এবং তার মৃত্যুর পর দেখা গেল মৃত বাপ বাজারে প্রচুর দেনা করে গিয়েছেন, যার ফলে মল্লিকের টানাটানি হওয়াই উচিত ছিল, কিন্তু তা তো হলোই না বরং পূর্বের মতই সে হৈ হৈ করে বেড়াতে লাগলো।
তারপর?
তারপর হঠাৎ বছর দুয়েক বাদে সে যে কোথায় উধাও হয়ে গেল বাজারে প্রচুর দেনা করে কেউ জানতে পারল না। অনেকদিন পরে অবিশ্যি জানা যায় যে সে গিয়েছিল মগের মুলুকেই।
কিরীটী তালুকদারের কথা উগ্রীব হয়ে শুনছিল। এবার মৃদু কণ্ঠে বললে, তা হলে নরেন মল্লিকের বর্মা যাবার পশ্চাতে একটা উদ্দেশ্য পাওয়া গেল। পাওনাদারদের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া!
তা ছিল বৈকি। তাই তো অমল বলছিল, মল্লিক লোকটা যাদু জানে নচেৎ বর্মা থেকে পনের বছর পরে যখন ফিরে এলো, ব্যাগ ভর্তি করে সৌভাগ্য নিয়ে এলো কি করে? পনের বছরে কি করে সে ভাগ্যটাই ফিরিয়ে নিল?
তোমার ব্যারিস্টার ঘোষের সঙ্গে আমার একটু আলাপ করিয়ে দিতে পারো তালুকদার?
পারবো না কেন! কবে যেতে চাও বল!
যত শীঘ্র সম্ভব।
কাল চলো সন্ধ্যার পর।
বেশ তাই যাব, তাহলে এবারে উঠি।
এসো। আর একটা কথা তালুকদার!
কি বল তো?
বলছিলাম শুধু নরেন মল্লিকের বাড়িটাই আর একবার ভাল করে সার্চ করা নয়, ঐ সঙ্গে কৃষ্ণা কাবেরীদের ফ্ল্যাটটাও আর একবার ভাল করে সার্চ করা প্রয়োজন।
তার মানে সেই খোঁড়া সঞ্জীব চৌধুরীর ফ্ল্যাট! না বাবা, সেখানে আমি যেতে পারবো না। ভদ্রলোক যেন খোঁচা খাওয়া বাঘের মত সর্বদা থাবা বাড়িয়েই আছে। যেতে হয় তুমি যাও।
বেশ, আমিই না হয় যাবো। হাসতে হাসতে কিরীটী বলে, তাহলে তুমি যাও মল্লিক ভবনে।
তা যাবো।
বিদায়ের আগে রহমান সাহেব বললেন, ডাইরীটা কি তাহলে আপনার কাছেই—
হাঁ রহমান সাহেব। ডাইরীটা আমার কাছেই থাক।
রহমান ও তালুকদার বিদায় নিল। কিরীটী কিন্তু উঠলো না। সে যেমন সোফার উপরে বসেছিল তেমনই বসে রইলো।