মিঃ রায়!
বসুন–বসুন রহমান সাহেব। কি ব্যাপার, কি এমন নতুন ব্যাপার হঠাৎ আবিষ্কার করলেন?
সত্যি নতুন আবিষ্কারই বটে। তবে বুঝলেন কি করে? বসতে বসতে রহমান সাহেব বললেন।
আপনার চোখ-মুখই যে তারস্বরে বলছে রহমান সাহেব।
কিন্তু আবিষ্কারটা কি বলুন তো?
এ কেসের ব্যাপারে একটা দামী ডকুমেন্ট। বলতে পারেন হয়ত সূত্রও।
সূত্র!
হাঁ—একটা ডাইরী।
কার? মৃত নরেন মল্লিকের বোধ হয়?
আশ্চর্য! তাই। এই দেখুন—বলতে বলতে পকেট থেকে রহমান সাহেব একটা কালো মরোক্কোয় বাঁধা ছোট ডাইরী বের করে এগিয়ে দিলেন কিরীটীর দিকে।
আগ্রহে ও কৌতূহলে ডাইরীটা রহমান সাহেবের হাত থেকে নিয়ে কিরীটী ডাইরীটার পাতা উল্টাতে শুরু করলো। হাতের লেখাটি বিশেষ সুবিধার নয়। তবে নেহাত পড়তে কষ্ট হয় না। ইংরাজীতে লেখা ডাইরী। নিয়মিত সন তারিখ দিয়ে সুসংবদ্ধ ডাইরী নয়।
এলোমেলো খণ্ড খণ্ড ছিন্ন বিক্ষিপ্ত সব ঘটনা বা সংবাদ নোট করা হয়েছে ইংরাজীতে।
একের চার অংশ ডাইরীর পাতাগুলো পড়ে পড়ে চোখ বুলিয়ে উল্টিয়েও বিশেষ তেমন কোন আগ্রহের সৃষ্টি করে না বা মনের কোথাও কৌতূহল জাগায় না, তবু কিরীটী পাতাগুলো উল্টে যেতে থাকে।
হঠাৎ মাঝামাঝি জায়গায় একটা পাতায় এসে তার নজর পড়ল, লেখা আছে— কলকাতায় বাড়ি কিনলাম। সমীর এই বাড়ি কেনার ব্যাপারে আমাকে যথেষ্ট সাহায্য করেছে। বাড়িটা আমার পছন্দসই হয়েছে।
ব্যাস্ ঐ পর্যন্তই।
তারপর কয়েকটা পাতায় হিসাবের অঙ্ক। আবার কিরীটী উল্টে চলে পৃষ্ঠা। এবং সাত আট পৃষ্ঠা বাদে আবার এক জায়গায় এসে তার দৃষ্টি সজাগ হয়ে ওঠে। লেখা আছে কি আশ্চর্য! হঠাৎ যেন চমকে উঠেছিলাম ওর কণ্ঠস্বরে। কত দিন হয়ে গেছে, তবু যেন ভুলতে পারি নি আদৌ সে কণ্ঠস্বর। অদ্ভুত আশ্চর্য মেয়ে! শোনা মাত্রই মনে হলো যেন এ সেই তারই কণ্ঠস্বর। দূর, এসব কি ভাবছি! কোথাকার কে তার ঠিক নেই। তাছাড়া কত সময় একের কণ্ঠস্বরের সঙ্গে অন্যের কণ্ঠস্বরের তো কত আশ্চর্য মিলই না থাকে। এও হয়ত তাই।
এ আমার মনের ভুল নিশ্চয়ই।
আবার কয়েক পৃষ্ঠা পরে একটা পৃষ্ঠা। —আশ্চর্য! ওর কণ্ঠস্বর শুনলে এবং ওর চলা দেখলে তার কথাই আমার মনে পড়ে কেন? সে তো কবে মরে ভূত হয়ে গিয়েছে রেল গাড়িতে কাটা পড়ে। না না, এ আমার মনের ভ্রম ছাড়া আর কিছুই নয়। মিথ্যে কল্পনা।
কয়েক পৃষ্ঠা পরেই আবার এক পৃষ্ঠায়।
আশ্চর্য! কদিন থেকে কেবলই মনে হচ্ছে, কে যেন অনুক্ষণ আমাকে ছায়ার মত অনুসরণ করছে। বাড়িতে যতক্ষণ থাকি মনে হয় যেন ছায়ামূর্তি আমার পিছনে পিছনে ফিরছে। ডাক্তারের পরামর্শ নিয়েছিলাম। তিনি বললেন, নিউরোসিস। স্নায়ুর দুর্বলতা শেষ পর্যন্ত কিনা আমার মধ্যে দেখা দিল!
সত্যিই কি আমি দুর্বল হয়ে পড়েছি? না এটা বয়সের দোষ? অন্য আর একটি পৃষ্ঠায়।
সত্যি, আশ্চর্য মুখের সৌসাদৃশ্য তো! যেন একেবারে তারই প্রতিচ্ছবি। কতকাল আগেকার কথা—স্মৃতির পৃষ্ঠা ঝাপসা হয়ে এসেছে, তবু সেই ঝাপসা পটে আজও যে দুচারটে রেখা মনে আছে তার সঙ্গে যেন কোন পার্থক্য নেই।
নতুন আর একটি পৃষ্ঠা।
মাঝে মাঝে লোভ হচ্ছে বটে ককে নিয়ে ঘর বাঁধি। কিন্তু সাহস হয় না। এই জ্বলন্ত অগ্নিশিখাকে ঘরের মধ্যে হয়ত ধরে রাখতে পারব না। হয়ত বৃথাই পুড়ে ঝলসে যাব। তার চাইতে এই ভালো। থাক সে অবন্ধনা। চট করে ছেড়ে আমাকে যাবে না। কারণ অর্থের খাকতি আছে। ও অবিশ্যি ভাবে যে আমি সেটা বুঝি বুঝতে পারছি না, কিন্তু জানে না তো ওদের মত মেয়েদের অন্তত আমার আর চিনতে বাকী নেই।
আমি ওদের ভাল করেই চিনি।
তারপর ডাইরীর আরো কয়েকটা পৃষ্ঠা কিরীটী উল্টে যায়, কিন্তু বিশেষ তেমন কিছু উল্লেখযোগ্য চোখে পড়ে না। ডাইরীটা অতঃপর ধীরে ধীরে মুড়ে তাকালো রহমান সাহেবের মুখের দিকে।
এতক্ষণ রহমান সাহেব নিঃশব্দেই কিরীটীর মুখের দিকে তাকিয়ে বসে ছিলেন। কিরীটী
ওঁর মুখের দিকে তাকাতেই বললেন, পড়লেন?
হাঁ। কোথায় পেলেন এ ডাইরীটা?
নরেন মল্লিকের বেড়রুমে বিছানার নিচে ছিল। ডাইরীটা মধুই গতকাল বিছানাপত্র রোদে দিতে গিয়ে পায়। তারপর আজ বিকেলে থানায় এসে দিয়ে গেল আমাকে।
মধু এসেছিল আজ থানায়?
হ্যাঁ, বললাম তো সে দিয়ে গেল।
মল্লিক-গৃহের আর কোন নতুন খবর পেলেন?
নতুন খবর আর কি পাবো! পাবার মত আর আমাদের আছেই বা কি? বিনতা দেবীর কোন সংবাদ জানেন?
বিনতা দেবী!
হ্যাঁ, উনি তো সেদিন বলছিলেন সুবিমলবাবুকে চাকরি ছাড়বার নোটিশ দিয়ে দিয়েছেন। তা তিনি চলে গিয়েছেন, না আছেন এখনো জানেন কিছু?
হ্যাঁ, মধুই নিজে থেকে বলল বিনতা দেবী দিন পাঁচেক হলে চলে গিয়েছেন। তারপর একটু থেমে রহমান সাহেব প্রশ্ন করলেন, ডাইরীটা পড়ে কিছু বুঝতে পারলেন মিঃ রায়?
বিশেষ তেমন কিছুই আপাততঃ বুঝতে পারছি না। তবে একটা কথা আমার কি মনে হচ্ছে জানেন?
কি? রহমান সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকালেন কিরীটীর মুখের দিকে।
নিহত নরেন মল্লিক সম্পর্কে আমরা আজ পর্যন্ত যেটুকু তার অতীতের জীবন থেকে জেনেছি সেটা সামান্যই।
কি রকম?
তাই। আমার মনে হচ্ছে নিহত নরেন মল্লিকের অতীত জীবনের পৃষ্ঠাগুলোতে এমন কিছু আছে যেখানে হয়ত তার এই আকস্মিক হত্যা রহস্যের কোন বড় রকমের একটি জটিল সূত্র রয়ে গিয়েছে।