নরেন মল্লিকের বাড়িতে সকালবেলা সুবিমলের কক্ষে সুবিমল চেয়ারে বসে চা-পান করছে, সামনে দাঁড়িয়ে মধু।
মধুই কথাগুলো বলছিল।
কিন্তু এ কথা তোকই এতদিন তুমি আমাকে বল নি মধুদা!
এতদিন বলি নি দাদাবাবু, কিন্তু আর না বলে পারলাম না। হরি, যদু, ঠাকুর ওরা তো বেশ ভয় পেয়েই গেছে।
ভয় পেয়েছে?
হ্যাঁ, ওরা বলাবলি করছিল কর্তাবাবুর অপঘাতে মৃত্যু হয়েছে–তাঁর প্রেতাত্মা–
Nonsense! সে যাক্, এক কাজ করো, আজ থেকে ওঘরে তালা দিয়ে রেখো।
বেশ।
.
কিরীটীর বাড়িতে। কিরীটী ও তালুকদারের মধ্যে কথোপকথন হচ্ছিল। সামনে ক্রিয়ের ওপরে কাপে চা। মধ্যে মধ্যে ওরা চা-পান করছে।
সেই লোকটার উপরে বেশ ভাল করে নজর রাখা হয়েছে তো তালুকদার?
হ্যাঁ, ভূপেন রথীন আর যতীন তিনজনকে নিযুক্ত করা হয়েছে। প্রায়ই লোকটাকে নরেন মল্লিকের বাড়ির আশেপাশে ও কাবেরীদের বাড়ির কাছে ঘোরাফেরা করতে দেখা যাচ্ছে।
ও লোকটার রহস্য সব জানতেই হবে। লোকটার বাড়ি, জাতি, পেশা—সব।
কিছু কিছু জেনেছি—লোকটা জাতিতে পাঠান, পেশা দালালী, ব্রোকার। থাকে Taj Hotelয়ে, একটা কালো রংয়ের সিডনবডি গাড়ি আছে। গাড়ির নং BLA 6786.
আর একটা কথা, সঞ্জীব চৌধুরীর অতীত ইতিহাসটা জানা গেল?
সামান্য–লোকটা এককালে আসামের এক চা-বাগানে ম্যানেজার ছিল এবং প্রচুর নগদ পয়সা ও স্থাবর সম্পত্তি কলকাতার ওপরে তিনখানা বাড়ি ছিল। এককালের নামকরা আধুনিক সমাজের মেয়ে করুণা সেনকে বিবাহ করেছিল। বিবাহের পর স্ত্রী এখানেই থাকত। লোকটার মাঝখানের দীর্ঘ ১৫ বছরের ইতিহাসটা শুধু এখনো জানা যায় নি।
বেশ। আর সুবিমল? তার ওপরেও নজর রেখেছ তো?
হ্যাঁ, এইটুকু বোঝা গিয়েছে, দুটি বোনের একটির সঙ্গে তার যথেষ্ট হৃদ্যতা আছে। কিন্তু দুটি বোনকেই হুবহু একই রকম দেখতে হওয়ায় আমার লোকেরা এখনো স্থির করতে পারে নি কোন্ বোনটি আসলে সুবিমলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠা। ভাল কথা, তোমাদের ডাক্তার গুপ্ত কি বলেন?
আপাততঃ সে বেচারীও হর্নস অব এ ডায়লেমাতে পড়েছে হাসতে হাসতে জবাব দেয় কিরীটী।
কি রকম?
হ্যাঁ, বেচারী এখনও ঠিক করেই উঠতে পারে নি কার প্রেমে সত্যি সত্যি পড়লো!
ইনটারেস্টিং তো!
তা একটু বৈকি, কিন্তু সে যাক্-একটা কথা—
কি?
নিহত নরেন মল্লিকের শয়নকক্ষটা আরো একবার ভালো করে তন্ন তন্ন করে আমাদের সার্চ করতে হবে অর্থাৎ সেই ঘরের আলমারি, ডেস্ক, ড্রয়ার ইত্যাদিগুলো।
হঠাৎ ডেস্ক, ড্রয়ার ইত্যাদি—কোন কিছু পাওয়া যাবে আশা করো নাকি?
একেবারে করি না বললে সত্যের অপলাপই করা হবে বৈকি।
যদি কিছু না মনে কর তো আরো একটু যদি বিশদভাবে খুলে বল।
কত কি-ই তো পাওয়া যেতে পারে, যেমন ধরো চিঠিপত্র কিংবা কোন মূল্যবান কাগজপত্র বা অন্য ধরনের কিছু–
হুঁ, বুঝেছি।
৩. নিহত নরেন মল্লিকের গৃহ
নিহত নরেন মল্লিকের গৃহ থেকে ফিরবার পর থেকেই কয়েক দিন ধরে কিরীটীর সমস্ত ঘটনার মধ্যে এবং মল্লিক-গৃহে যে যে মুখগুলি কিরীটী দেখেছিল তাদের মধ্যে বিশেষ একটি মুখ—যেটা তার দেখবার সৌভাগ্য হলো না, দীর্ঘ অবগুণ্ঠনের আড়ালে ঢাকাই ছিল, সেই অদেখা মুখখানির কথাই বার বার তার মনে পড়ছিল। মুখখানি কেমন কে জানে! তবে দেহের রং ও হাতের পায়ের ও দেহের গঠন দেখে মনে হয় মুখখানি নিশ্চয় ছিল সুন্দর।
কিন্তু সুন্দরই যদি মুখখানি হবে তবে তাকে সর্বদা সযতনে অবগুণ্ঠনে ঢেকে রাখবার টী বলতে কেউ তো দেখে নি বা শোনেই নি, এমন কি কেউ তার অবগুণ্ঠন উন্মোচিত মুখখানিও নাকি দেখে নি।
কেন? কি কারণে তার নিজেকে ঐভাবে সযতনে আড়াল করে রাখবার প্রয়াস? বাড়ি বললেন বর্ধমানে এবং স্বামী তো নেই—এমন কি কোন আত্মীয়স্বজনও নাকি নেই তার। এবং পেটের দায়েই যখন তিনি মল্লিক-গৃহে এসে চাকরি নিয়েছিলেন তখন, আর চাকরিই বা এখন করবেন না কেন? সুবিমলবাবুকে ইতিমধ্যে চাকরি ছাড়বার নোটিশ পর্যন্ত দিয়ে দিয়েছিলেন। চাকরি করবেন না আবার দেশেও ফিরে যাবেন কিনা বলতে পারলেন না।
কারো সঙ্গে মল্লিক-গৃহে কথা বলতেন না, অবগুণ্ঠনের অন্তরালে সর্বদা নিজেকে গোপন করে রাখতেন অথচ সর্ব ব্যাপারেই নজর ছিল তার। এমন কি ঐ গৃহে কৃষ্ণা বা কাবেরীর যাতায়াতের ব্যাপারটাও তার অজ্ঞাত ছিল না। আত্মগোপনেচ্ছু অথচ সজাগ।
কয়েক দিন ধরে অনবরত চিন্তার পর কিরীটী তার পকেট-ডাইরীটা খুলে সেদিন সন্ধ্যার দিকে সোফার ওপরে বসে নিজের ঘরে পাতা উল্টোতে লাগল।
এক জায়গায় এসে তার চোখের দৃষ্টি স্থির হলো।
সেই পাতার মধ্যস্থলে কালিতে একটি বৃত্ত আঁকা। বৃত্তের মধ্যস্থলে লেখা নিহত নরেন মল্লিক। এবং বৃত্তের গা থেকে তিনটি এ্যারো (তীরচিহ্ন) টানা। একটির মাথায় লেখা কৃষ্ণা, একটির মাথায় কাবেরী ও একটির মাথায় লেখা সঞ্জীব চৌধুরী। কিরীটী পকেট থেকে কলমটা বের করে বৃত্তটির গায়ে আর একটি নতুন তীরচিহ্ন আঁকলো এবং তার শেষপ্রান্তে লিখল বিনতা দেবী–রহস্যময়ী। সঙ্কেতময়ী।
সিঁড়িতে এমন সময় পদশব্দ পাওয়া গেল। ভারী জুতা পায়ে দিয়ে কে যেন দ্রুত উপরে উঠে আসছে।
পদশব্দ কিরীটীর পরিচিত এবং তাই বুঝতে কষ্ট হয় না আগন্তুক স্বয়ং রহমান সাহেব। রহমান সাহেব বেশ দ্রুতই এসে ঘরে প্রবেশ করলেন। চোখের দৃষ্টিতে স্পষ্ট একটা উত্তেজনার আভাস যেন চিক চিক করছে।