অধীর কণ্ঠে বলে ওঠে, চল—আমরা যাই।
এখনি উঠবে? আর একটু বসবে না?
না চল। ওঠ। কাবেরী উঠে দাঁড়ায়।
বয়—বিল লাও। সুবিমল বেয়ারাকে ডাকে।
.
পরের দিন প্রত্যুষে। কৃষ্ণা কাবেরীদের ফ্ল্যাটবাড়ির বাইরের কক্ষ।
কৃয়া বসে বসে ঐদিনকার সংবাদপত্রটা পড়ছে, কাবেরী এসে কক্ষে প্রবেশ করল, চোখে মুখে বেশভূষায় সদ্য নিদ্রাভঙ্গের সুস্পষ্ট চিহ্ন। আজকাল কিছুদিন থেকে দুই বোনের নিবিড় একাত্মবোধ ও অন্তরঙ্গতার মধ্যে যেন একটা চিড় খেয়েছে। স্পষ্টভাবেই আজকাল যেন পরস্পর পরস্পরকে এড়িয়ে এড়িয়ে চলে।
কাল অত রাত করে ফিরলি যে কাবি! অফিস থেকে বের হয়ে কোথায় গিয়েছিলি?
একটা হাই তুলে সোফাটার উপর বসতে বসতে কাবেরী বলে, গিয়েছিলাম—
গিয়েছিলি তা তো জানিই, কিন্তু কোথায় অত রাত পর্যন্ত ছিলি তাই তো জিজ্ঞাসা করছি।
ডাঃ গুপ্তর ওখানে।
সংবাদপত্র হতে মুখ তুলে বিস্মিত দৃষ্টিতে কৃষ্ণা কাবেরীর মুখের দিকে তাকাল।
Sitting ছিল বুঝি?
না।
তবে?
তবে আবার কি? পরিচিত লোকদের সঙ্গে একমাত্র কাজ না থাকলে কি আর দেখাসাক্ষাৎ করা যেতে পারে না? এমনি একটা social call!
বাবা না নিষেধ করে দিয়েছিলেন সেখানে যেতে! আশা করি ভুলে যাস নি এত তাড়াতাড়ি–
না, ভুলবো কেন? স্মৃতিশক্তি আমার এখনো এত ক্ষীণ হয় নি যে—
সহসা এমন সময় কক্ষের আর্শিতে সঞ্জীবের ছায়াপাত হলো।
ক্রাচে ভর দিয়ে ইতিমধ্যে কখন একসময় নিঃশব্দে ওদের অলক্ষ্যে সঞ্জীব দরজার গোড়ায় এসে দাঁড়িয়েছেন ওরা দুজনার একজনও টের পায় নি।
স্মৃতিশক্তি তোমার অবশ্য তা হলে প্রশংসনীয়ই বলতে হবে কাবেরী—
যুগপৎ দুই বোনই চম্কে ফিরে তাকালো এবং সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়াল।
অস্ফুট শব্দ দুজনারই কণ্ঠ হতে নির্গত হলো, বাবা!
সঞ্জীব ক্রাচে ভর দিতে দিতে কক্ষে প্রবেশ করলেন।
তাহলে আবার তুমি ডাক্তারের ওখানে গিয়েছিলে কাবি! আশ্চর্য, আমার আদেশ অমান্য করতে সাহস করো! সঞ্জীবের চোখের মণি দুটোতে অদ্ভুত একটা আলো দেখা দেয়, হিংস্র কুটিল।
সভয়ে কৃষ্ণা বলে ওঠে, বাবা!
কি? জবাব দিচ্ছ না যে? আবার সঞ্জীবের কণ্ঠ শোনা গেল। কঠিন নির্মম।
আমি—
সহসা বোমার মতই ফেটে পড়েন সঞ্জীব—আমি! আমি কি? কেন–কেন আমার নিষেধ সত্ত্বেও ফের আবার ডাঃ সুকুমার গুপ্তের চেম্বারে গিয়েছিলে? বল—জবাব দাও!
কাবেরী চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে, কোন জবাব দিতেই বোধ হয় সাহস পায় না। সঞ্জীবের দুচক্ষুর তীক্ষ্ণ, অন্তর্ভেদী দৃষ্টি যেন কাবেরীর সর্বাঙ্গে দ্রুত পরিক্রম করছে। স্তব্ধতা। নীরেট পাষাণের স্তব্ধতা সমগ্র কক্ষখানি জুড়ে।
সহসা আবার সঞ্জীবের কণ্ঠস্বর শোনা গেল, বেশ, আজই ডাক্তারের কাছে কালকের দরুন ১০০ টাকার একটা বিল দেবে–
বাবা! আর্তকণ্ঠে চিৎকার করে ওঠে কাবেরী।
হ্যাঁ, আমার মেয়েরা বেকার নয় লোফার নয়, তাদের প্রতিটি মুহূর্তের দাম আছে।
বাবা–, আবার কাবেরী কি যেন বলবার চেষ্টা করে।
না, কোন কথাই আমি শুনতে চাই না। বিল তুমি দেবেই, হ্যাঁ, এই আমার আদেশ—আমার আদেশ। বাধা দিয়ে সঞ্জীব বলে ওঠেন।
না না, আমি পারবো না, আমি তা পারবো না! রুদ্ধ কণ্ঠে প্রতিবাদ জানায় কাবেরী।
পাষাণের মত দাঁড়িয়ে থাকে এক পাশে কৃষ্ণা।
পারবে না? গর্জন করে ওঠেন সঞ্জীব।
না, না-পারবো না। আমি পারবো না। বলতে বলতে স্খলিত পদে কাবেরী ঘর থেকে চলে যায়।
পারবে না? কাবেরী? কাবেরী? কাবেরী? বলতে বলতে সঞ্জীব মেয়েকে অনুসরণ করতে যেতেই এতক্ষণে কৃষ্ণা এসে বাপকে দুহাতে আগলে দাঁড়ায়।
বাবা! বাবা—
কৃষ্ণা! থমকে দাঁড়ান সঞ্জীব।
বাবা-কাবি ছেলেমানুষ, ওকে ক্ষমা করুন। ও—
ক্ষমা! হাঃ হাঃ—পাগলের মতই উচ্চৈঃস্বরে হেসে ওঠেন সঞ্জীব।
ক্ষমা-সঞ্জীব চৌধুরী ক্ষমা কাউকে করে না। কিন্তু আমি জানতাম, এ আমি জানতাম। রক্তের ঋণ তোমাদের শোধ করতেই যে হবে—করুণার দেহরক্তের বিষ। জানতাম, আমি জানতাম—বিষ একদিন ফেনিল হয়ে উঠবেই, তাকে কেউ রোধ করতে পারবে না। কেউ রোধ করতে পারবে না।
বাবা–তুমি হাঁপাচ্ছ। বসো, এই চেয়ারটার ওপরে বসো।
কৃষ্ণা সঞ্জীরকে টেনে এনে চেয়ারটার উপর বসিয়ে দেয়।
কৃষ্ণা, শোন। এ বাড়ি ছেড়ে এ শহর ছেড়ে–যত শীঘ্র সম্ভব আমাদের চলে যেতে হবে।
চলে যাবে? কোথায়?
জানি না। শুধু এইটুকু জানি দূরে—দূরে–বহুদূরে।
কিন্তু–
শোন, তোমাদের আমি এতদিন বলি নি–তোমাদের অনুপস্থিতিতে দুতিনদিন রাত্রে এ বাড়িতে নিশ্চয়ই চোর এসেছে–
চোর!
হ্যাঁ, খস খস শব্দ শুনে আমি পাশের ঘরে গিয়েছি—ঘর অন্ধকার। আলো জ্বেলে কাউকে দেখতে পাই নি। কিন্তু আমি নিশ্চিত, কোন অজানা লোক আমাদের ছায়ার মতই অলক্ষ্যে অনুসরণ করে বেড়াচ্ছে। তার পদশব্দ আমি শুনতে পেয়েছি।
কিন্তু বাবা, তেতলার ফ্ল্যাটে যে আমরা—
বিশ্বাস কর কৃষ্ণা, এসেছে, নিশ্চয়ই কেউ এসেছে—তার স্পষ্ট পদশব্দ আমি শুনেছি। বেশী দিন নয়, নরেন মল্লিকের মৃত্যুর কিছুদিন আগে থেকেই এ ব্যাপারটা চলেছে–
নরেন মল্লিকের মৃত্যুর কিছুদিন আগে থেকেই! আর্তকণ্ঠে যেন চিৎকার করে বলে ওঠে কৃষ্ণা।
হাঁ।
ফ্যালফ্যাল্ করে বোবাদৃষ্টিতে কৃষ্ণা তার বাবার মুখের দিকে চেয়ে থাকে।
.
হাঁ বাবু—কর্তাবাবু মারা যাবার পর থেকে প্রায়ই রাত্রে উপরের তলায় বাবুর ঘরটার মধ্যে কি সব শব্দ শোনা যায়। কখনো মনে হয় কে যেন হেঁটে বেড়াচ্ছে, কখনো মনে হয় কেউ বা কারা যেন ঘরের সব জিনিসপত্র নাড়াচাড়া করছে। শুধু আমিই নয় দাদাবাবু, হরি আর যদুও শুনেছে–