আজ পার্টি, কাল উৎসব—একটা না একটা লেগেই থাকত নরেন মল্লিকের গৃহে; মোট কথা নরেন মল্লিক যা চেয়েছিল তা দিনেই হাতের মুঠোয় এসে গেল। ঐ সঙ্গে এলো প্রতিষ্ঠা।
আত্মীয়স্বজন বলতে গৃহে নরেন মল্লিকের এক ভাগ্নে, নাম সুবিমল এবং বয়স তার ৩০৩২য়ের মধ্যে। সুবিমলও বিবাহাদি করে নি, বি. এ. পাস। ইনসিওরেন্সের মাহিনা করা দালাল। দেখতে সুশ্রী না হলেও মোটামুটি শরীরে একটা আলগা শ্ৰী আছে। বলিষ্ঠ দোহারা দেহের গঠন, বেশ একটু সৌখীন প্রকৃতির।
সুবিমল ছাড়া বাড়িতে পুরাতন বৃদ্ধ ভৃত্য মধু; হরি ও যদু দুটি ভৃত্য, ঠাকুর জগন্নাথ, দারোয়ান রামভজন সিং ও রামখেল সিং, ড্রাইভার নন্দুয়া এবং বিনতা। আর বাড়িতে ঐ বিনতাই ছিল একমাত্র স্ত্রীলোক। বিনতা ভদ্রঘরের ব্রাহ্মণের বিধবা, মধ্যবয়সী। প্রকৃতপক্ষে নারীহীন সংসার নরেন মল্লিকের বিনতাই সব দেখাশুনা করতো। এবং ভদ্রমহিলা সব দেখাশুনা করলেও কখনও নরেনের সামনে বড় একটা বের হতো না। আর সর্বদাই মুখের ওপর টানা থাকত একটি দীর্ঘ অবগুণ্ঠন।
নিরবচ্ছিন্ন আনন্দের মধ্যে দিয়েই দিন কেটে যাচ্ছিল নরেন মল্লিকের। কোন একটি নবলব্ধ বান্ধবীর জন্মতিথি উৎসব অত্যাসন্ন—সুন্দরী, তরুণী বান্ধবী, একটা ভাল রকম প্রেজেন্টেশন দিতে হবে।
সন্ধ্যার কিছু পরে নরেন মল্লিক হীরালাল শেঠের প্রকাণ্ড জুয়েলারীর দোকানের সামনে এসে গাড়ি থেকে নামল।
আধুনিক ডিজাইন ও প্যাটার্ণের স্বর্ণালঙ্কার বিক্রেতা হিসাবে হীরালাল শেঠের দোকানে অভিজাত মহলের সুন্দরীদের যাতায়াতটা খুব বেশী। উজ্জ্বল আলোয় শো কেসের জড়োয়ার গহনাগুলো বর্ণদ্যুতি বিকিরণ করছে।
নরেন মল্লিক দোকানের মধ্যে এসে প্রবেশ করল। দোকানের ম্যানেজার যমুনাদাস শেঠ নরেন মল্লিকের পরিচিত। শাঁসালো খরিদ্দার হিসাবে মল্লিক এ দোকানে বহুবার পদার্পণ করেছে ইতিপূর্বে, সেই কারণেই ম্যানেজার শেঠজী তাকে যথেষ্ট খাতিরও করেন।
আইয়ে আইয়ে মল্লিক সাব!
যমুনাদাস নরেন মল্লিককে দোকানে প্রবেশ করতে দেখেই সাদর আহ্বান জানায়।
মল্লিক ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি নিয়ে এগিয়ে আসে, নমস্তে যমুনাদাসজী। তবিয়ৎ আচ্ছা তো?
আপকি মেহেরবানি। ফরমাইয়ে সাব কেয়া দেখাউঁ—
আসলি মুক্তাকা কৌই হার হ্যায় তো জেরা মেহেরবানি করকে দেখাইয়ে শেঠজী—
আসলি মুক্তা! চলিয়ে সাব উধার, ও কাউন্টারকে পাশ–
দোকানের পশ্চিম কোণে একটু নিরিবিলি কাউন্টারের ছোট একটি অংশ, স্বল্প আলোআঁধারিতে ঘেরা। একপাশে স্ট্যাণ্ডের উপরে সবুজ ডোমে ঢাকা উজ্জ্বল বৈদ্যুতিক বাল্ব জ্বলছে—আলোর নিচে আট-দশটা মুক্তার হার বের করে এনে ছড়িয়ে দিল যমুনাদাস, মল্লিকের সামনে।
লিজিয়ে মল্লিক সাব! সব আসলি মুক্তা!
নরেন মল্লিক হারগুলি পরীক্ষা করতে থাকে আলোয়।
হঠাৎ সামান্য দূরে কাউন্টারের অপর পার্শ্ব হতে একটা ঈষৎ চাপা ভারী গলা শোনা যায়, কোই দামী নেকলেস দেখাইয়ে সাব। হীরাকা নেকলেস। বহুৎ আচ্ছা হীরা হোনা চাইয়ে—
বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতই যেন চম্কে ফিরে তাকায় ঐকণ্ঠস্বরে নরেন মল্লিক। হাতপাঁচেক ব্যবধান মাত্র। লম্বাচওড়া দীর্ঘকায় এক পাঠান। পরিধানে দামী নেভী-রু সার্জের স্যুট, মাথায় কালো ফেজ। মুখের একাংশ মাত্র দেখা যাচ্ছে। উজ্জ্বল আলোর খানিকটা তির্যক ভাবে মুখের দক্ষিণ অংশে এসে পড়েছে।
দীর্ঘ একটা ক্ষতচিহ্ন দক্ষিণ অক্ষিকোণ হতে গালের অর্ধাংশ পর্যন্ত বিস্তৃত।
নরেন মল্লিক তাড়াতাড়ি মুক্তার হারগুলো এক পাশে ঠেলে দিয়ে বলে ওঠে, ফির দোসরা কোই টাইমমে কাল আয়েঙ্গে শেঠজী। আচ্ছা নমস্তে।কতকটা যেন হন্তদন্ত হয়েই নরেন মল্লিক দোকান থেকে বের হয়ে আসে।
হঠাৎ পাঠান এমন সময় বলে ওঠে, এ কেয়া হীরা হায়! হীরা—ম্যায় আসলি হীরা চাহাতে হুঁ!
নরেন মল্লিক গাড়ির দরজা খুলে ঝুপ করে গাড়ির পিছনের গদীতে বসে পড়েই বলে, নন্দুয়া, বাড়ি!
সে রাত্রে নরেন মল্লিকের ভাল ঘুম হয় না। তার মনে হয় দীর্ঘকায় একটা ছায়ামূর্তি যেন তার শয্যার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। মুখে একটা কালো মুখোশ। ভীতিবিহ্বল দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে নরেন মল্লিক। মুখখাশের দুটি গোলাকার ছিদ্রপথে, দুটি চক্ষু তো নয় যেন দুটি অগ্নিগোলক জ্বলজ্বল করছে। ধীরে ধীরে মুখোশধারী এগিয়ে আসছে শয্যার দিকে, পায়ে পায়ে নিঃশব্দে। এসে দাঁড়াল একেবারে শয্যার গা ঘেঁষে।
তারপর একটু একটু করে মুখখাশটা যেন উন্মোচন করে ছায়ামূর্তি।
কে! কে! ঘুমের ঘোরেই চিৎকার করে ওঠে নরেন মল্লিক। ঘুম ভেঙে যায় নরেন মল্লিকের। অন্ধকার ঘরে সামান্য একটুখানি চাঁদের আলো খোলা জানালাপথে এসে কক্ষমধ্যে লুটিয়ে পড়েছে। সর্বাঙ্গ ঘামে ভিজে গিয়েছে। হাত বাড়িয়ে আলোটা জ্বালিয়ে দেয় নরেন মল্লিক বেড় সুইটা টিপে। শূন্য ঘর। বাকী রাতটুকু চোখের পাতায় আর ঘুম আসে না।
আবার একদিন রাত্রি প্রায় সাড়ে এগারটায় গাড়িতে করে বেড়িয়ে ফিরছে নরেন মল্লিক, গাড়ি গেটের মধ্য দিয়ে ঢুকছে, হঠাৎ নরেনের দৃষ্টি যেন স্থির হয়ে যায়। রাস্তার গ্যাসপোস্টের আলো গেটের ওধারে এসে পড়ছে—সেই অস্পষ্ট আলোয় দেখে দীর্ঘ এক ছায়ামূর্তি, পরিধানে কালো স্যুট, স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ঠিক গেটেরই কাছে।