আবার কি কাজ?
That mysterious father of কৃষ্ণা কাবেরী—হ্যাঁ, কৃষ্ণা কাবেরীর বাপ ভদ্রলোকটি যেন নিজেকে একটা কুহেলীর আবরণে সযত্নে ঢেকে রেখেছেন; যতটুকু আজ পর্যন্ত ভদ্রলোকটি সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে জেনেছি, লোকটা ঘরের মধ্যে দিবারাত্র নিজেকে বন্দী করে রাখে, কারো সঙ্গে দেখা করে না, কথা বলে না, মেয়ে দুটির উপরে অসাধারণ একটা আধিপত্য ভদ্রলোকের, যার মধ্যে হয়তো আছে একটু হিংসা, একটু ভয়, একটু সন্দেহ ও একটু আশঙ্কা এবং সব কিছু মিলে রহস্যঘেরা বিকৃত ও অস্বাভাবিক একটা সংশয়।
এত সংবাদ তুই পেলি কোথা হতে?
পাওয়াটাই যে আমার কাজ—হাঁ বলছিলাম, শুধু তাই নয়, ভদ্রলোকের একটা পা paralytic, ক্রাচে ভর দিয়ে চলাফেরা করেন, রবীন্দ্রনাথ, মধুসূদন, সেক্সপীয়ার, মিল্টন, কীটস নিয়ে ও মদ্যপান করে সময় কাটান। সব কিছুতে মিলে একটা মিস্ত্রি, একটা কিউরিও। একটু থেমে আবার বলে, হয়ত ঐ পিতার রহস্যের সঙ্গেই কন্যা দুটিরও অনেক রহস্যের সন্ধান পাওয়া যাবে—অতএব তোকে ঐ বোন দুটির কাছ হতে যেমন করে হোক পিতা ও মেয়ে দুটির মধ্যে আসল ও সত্যিকারের সম্পর্কটুকু খুঁজে বের করে আনতে হবে, পারবি না?
আমি তো বুঝতে পারছি না–কি করে তা সম্ভব হবে?
কেন? প্রেম দিয়ে বন্ধু চিনিয়া লইও তোমার বঁধুর সে হৃদয়খানি।
.
ভিটোরিয়া মেমোরিয়াল-এর বাগানে নিরিবিলি একটা বৃক্ষতল। অদূরে গাছের নীচে দাঁড় করানো আছে ডাঃ সুকুমার গুপ্তর গাড়ি। পাশাপাশি বসে সুকুমার ও কৃষ্ণা।
একটা ঘাসের শীষ দাঁত দিয়ে কাটছে আনমনে কৃষ্ণা। সাধারণ পিঁয়াজী রংয়ের ব্লাউজ ও শাড়ি পরিধানে কৃষ্ণার, মাথার চুল এলো খোঁপার আকারে বাঁ কাঁধের উপর লুটিয়ে পড়েছে।
কি ভাবছেন ডাঃ গুপ্ত? কৃষ্ণা প্রশ্ন করে। টী করছো।
বেশ, তুমি বললে যদি আপনি সুখী হন তুমিই বলবো।
কথাটা বলতে বলতে কৃষ্ণা কেমন যেন অন্যমনস্ক হয়ে যায়।
কি ভাবছো? ডাক্তার প্রশ্ন করে।
ভাবছি এর চাইতে তোমার আমার পরিচয় না হলেই ভাল ছিল—
এ কথা কেন বলছো? এক-এক সময় তোমার হাবভাব দেখে মনে হয়, কি একটা গভীর সংশয় যেন দিবারাত্র তোমায় পীড়া দিচ্ছে। আমাকে সব কথা খুলে বল, এমনও তো হতে পারে তোমায় আমি সাহায্য করতে পারি।
না, না—তুমি জান না, তুমি তো জান না, কত বড় একটা দুঃস্বপ্ন দিবারাত্র ছায়ার মতোই আমাকে অনুসরণ করে ফেরে।
কৃষ্ণা আবার যেন অন্যমনস্ক, চিন্তিত হয়ে যায়।
শোন। সেদিনও তোমাকে বলেছি, আজও আবার বলছি আমি তোমার বাবার সঙ্গে একবার—
না, না—কতকটা আর্ত আকুল কণ্ঠেই যেন বলে ওঠে কৃষ্ণা, ও কাজও তুমি করো না, বাবাকে তুমি চেন না। মত তো তিনি দেবেনই না, আর এ জীবনে আমাদের পরস্পরের এই দেখাসাক্ষাৎ, এও তিনি চিরজীবনের মত বন্ধ করে দেবেন হয়ত।
কিন্তু চিরদিনই কি তাহলে আমাদের এমনি করেই লুকিয়ে-চুরিয়ে বেড়াতে হবে? প্রকাশ্যে তোমাকে কোনদিনই দাবী করতে পারবো না?
.
কলকাতা শহরের চৌরঙ্গী অঞ্চলে সুবিখ্যাত একটি ইংলিশ হোটেলের মধ্যে। আলোকিত হোটেলটি। বহু নরনারী একত্র বা জোড়া টেবিলে বসে পান ও আহার করছে। হোটেলের এক পাশে ইংরাজী বাজনা বাজছে নানা বাদ্যযন্ত্রের সাহায্যে। একটি কর্ণার সীটে মুখোমুখি বসে কাবেরী ও সুবিমল, সামনের টেবিলের উপরে রক্ষিত কেক চা ইত্যাদি। সুবিমলের পরিধানে সাহেবী পোশাক।
চা পান করতে করতে সুবিমল বলছিল, সত্যি বলতে পারো, এমনি করে কতকাল আর আমাদের লুকিয়ে-চুরিয়ে বেড়াতে হবে?
কি করব বল! তবু দেখাশুনাটাও তো হচ্ছে কাবেরী জবাব দেয়।
কিন্তু মেয়ে হয়ে যখন জন্মেছো, বিবাহ তো একদিন মেয়ের দিতেই হবে—তবে তোমার বাবার তোমাদের বিবাহে এত আপত্তিই বা কিসের?
বুঝতে পারি না, কেন বাবা কোন পুরুষের সঙ্গেই আমাদের মিশতে দেন না। এমন কি সেদিন রাত্রের sittingয়ের পর বাড়িতে ফিরে গেলে ডাক্তারের চেম্বারে যেতেও সেদিন হতে নিষেধ করে দিয়েছেন। তোমার সঙ্গে মিশি একথা ঘুণাক্ষরে জানতে পারলেও আর রক্ষা রাখবেন না।
কিন্তু এ অত্যাচার! সত্যি, ক্রমেই যেন এ আমার অসহ্য ঠেকছে। চলো—তার চাইতে না হয় আমরা বিবাহ করে তারপর তোমার বাবার কাছে
না না, এত তাড়াতাড়ি বিবাহ আমাদের হতেই পারে না। বাবা আমাদের বাবাকে তুমি জান না, তিনি আমাকে কিছুতেই তা হলে ক্ষমা করবেন না। আর তার ক্রোধ! না না, সে আমি ভাবতেও পারি না। তুমি—তুমি আমাকে ক্ষমা করো।
এমন সময় দীর্ঘকায় ফৈয়াজ, পরিধানে সাহেবী পোশাক আর চোখে কালো কাচের চশমা, এদিক ওদিক তাকাতে তাকাতে হোটেলে এসে প্রবেশ করল। এবং সহসা কাবেরী ও সুবিমলের উপর নজর পড়তেই ওদের অল্প দূরে একটা চেয়ারে এসে উপবেশন করে ভারী গলায় ডাকল, বোয়!
বেয়ারা এসে সেলাম দিয়ে পাশে দাঁড়াল, টি অ্যাণ্ড স্যাণ্ডউইচ।
বেয়ারা সেলাম দিয়ে চলে গেল।
ফৈয়াজ একটা পাইপ ধরিয়ে ধূমোদগীরণ করতে থাকে।
তোমাদের দুই বোনেরই তোমাদের বাবা সম্পর্কে এমন একটা আতঙ্ক কেন বল তো? হাজার হলেও তিনি তো তোমাদেরই বাপ-তোমরা তার সন্তান—আবার এক সময় সুবিমল বলে।
হ্যাঁ, কিন্তু না—বাবার অমতে কোন কিছু করা অসম্ভব, তাছাড়া বাকী কথাগুলো আর কাবেরী শেষ করে না, সহসা অদূরে পাঠানটির সঙ্গে চোখাচোখি হতেই কেমন যেন অস্বস্তি বোধ করে কাবেরী।