সহসা একটা আর্ত চিৎকার করে উঠে দাঁড়ায় কাবেরী, না! না! না!
কি হলো? কি হলো কাবেরী? ব্যস্ত হয়ে বলে ওঠে ডাঃ সুকুমার।
কাবেরী ততক্ষণে নিজের বিহ্বল, ভয়ার্ত ভাবটা সামলে উঠেছে। বড় রকমের একটা দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে বিষণ্ণ কণ্ঠে বলে, কিছু না। আমি বড্ড ক্লান্ত—feeling extremely tired! আমি এবারে যেতে চাই ডাঃ গুপ্ত।
চল, আমার ড্রাইভার তোমায় বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসবে—
না, না—তার কোন প্রয়োজন নেই, হঠাৎ কেমন মাথাটা ঘুরে উঠেছিল। আমি, আমি আমি একাই বাড়ি ফিরে যেতে পারবো।
না, তোমাকে সত্যিই অত্যন্ত পরিশ্রান্ত দেখাচ্ছে—তা ছাড়া ডাক্তার হিসাবে আমার একটা কর্তব্যও তো আছে—চল।
কাবেরী ডাক্তারের কথায় আর আপত্তি করে না।
আর আপত্তি করার মত শক্তিও তার ছিল না তখন।
নিচে এসে ড্রাইভারকে ডেকে ডাক্তার কাবেরীকে গাড়িতে তুলে দিল এবং ড্রাইভারকে ঠিকানা বলে দিল, মেমসাবকো সিধা কোঠি পৌঁছা দেনা লছমন্।
জি সাব্।
আপনার ফিস্টা মিস্ চৌধুরী–
ডাক্তার পকেট হতে দশ টাকার দশখানা নোট গাড়ির জানালাপথে এগিয়ে দিল কাবেরীর দিকে।
কাবেরী কুণ্ঠার সঙ্গে নোটগুলো হাতে নেয়।
আচ্ছা Good Night!
Good Night। মৃদুকণ্ঠে কাবেরী জবাব দিলে।
গাড়ি চলে গেল।
কাবেরীকে বিদায় দিয়ে সুকুমার চেম্বারে আবার যখন ফিরে এলো, দেখলে কিরীটী একটা সোফার ওপরে বসে পায়ের ওপরে পা তুলে দিয়ে চোখ বুজে একটা বর্মা সিগার নিঃশব্দে টানছে। সিগারের তীব্র কটু গন্ধ কক্ষের বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে। সুকুমারের পদশব্দে চোখ খুলেই এবং দাঁত দিয়ে সিগারটা চেপে ধরে কিরীটী বললে, কাবেরী দেবী চলে গেলেন?
সুকুমার সিগারেট কেসটা পকেট হতে বের করে, একটা সিগারেট নিয়ে ওষ্ঠের ফাঁকে চেপে ধরে অগ্নিসংযোগ করতে করতে বললে, হুঁ। কিন্তু ব্যাপারটা ঠিক কি হলো বুঝতে পারলাম না। হঠাৎ কাবেরী অমন হিস্টিরিক ব্যবহার করলে কেন?
মনস্তাত্ত্বিক তুমি ডাক্তার, বোঝা উচিত ছিল। রোমান্টিক মাইণ্ড!
রোমান্টিক মাইণ্ড সে তো নিশ্চয়ই, কিন্তু—
আবার তবে কিন্তু কেন? ভাবুক মনের কল্পনাবিলাস বা স্বপ্ন—
কিন্তু একটা কথা–
কি?
So far তোমার কাজ excellent! চমৎকার। কিন্তু এবারে তোমাকে একটু ঘনিষ্ঠ হতে হবে।
মানে?
মানে–প্রেমের ব্যাপারে দুটির সঙ্গেই তোমার আরো একটু ঘনিষ্ঠ হতে হবে। যদিচ সেটা বিশেষ তোমার মত তরুণের পক্ষে জানি নিদারুণ risky খেলা—
কি বলছিস কি?
আহা অবোধ শিশুটি রে! কিছু যেন বুঝতে পারছেন না! শোন হে মনস্তাত্ত্বিক, অবশ্য মর্মে মর্মে উপলব্ধি করছি একটি ভগিনীর প্রেমে আপাততঃ তুমি যদিচ হাবুড়ুবু নদের নিমাই—দ্বিতীয়টির সঙ্গেও নদের নিমাইদের অভিনয় করতে হবে।
আঃ, কি হচ্ছে সব!
মধুর! মধুর! কিন্তু সত্য কথা বলতে ভাই, কে? কৃষা না কাবেরী? সুকুমার কিরীটীর প্রশ্নের জবাব দেবে কি, নিজেই এখনো মনের মধ্যে স্থির সিদ্ধান্তে আসতে পারে নি, সত্যি কোন জন ওর হৃদয়কে আকর্ষণ করেছে!
কৃষ্ণা, না কাবেরী?
হৃদয় যেন দুলছে একবার এদিক, একবার ওদিক। এক বৃন্তে দুটি ফুল যেন দুটি বোন। মনকে কখনো আকর্ষণ করে কাবেরী, কখনো কৃষ্ণা। দ্বিধা-সংশয়ে দোলে মন।
কি? জবাব দিচ্ছিস না যে? নির্বাক-হতবাক যে!
কি বলবো তাই ভাবছি—
হুঁ। তা বন্ধু, বলি সাবধান! পূর্বকালে শাস্ত্রে বিষকন্যা বলে এক ধরনের কন্যার কথা শোনা যায়। পাতঞ্জলির শাস্ত্রে খুঁজলেই পাবে। এবং শোনা যায় ঐ অপূর্ব, মনোমোহিনী কন্যাদের স্পর্শেই নাকি মৃত্যু ঘটতো। কন্যার দেহ হতে বিষ সংক্রামিত হতো হতভাগ্য রূপমুগ্ধ প্রেমিকের দেহে। কৃষ্ণা ও কাবেরী তোমার ওই দুটি মানসপ্রিয়ার একটি কিন্তু কলির বিষকন্যা। অতএব সাবধান বন্ধু সাবধান
কি আবোল-তাবোল সব বকছিস? এখুনি হয়ত কৃষ্ণা আসবে—তারও আজ রাত্রেই sitting দেবার কথা—
অর্থাৎ বলতে চাও, তুমি যাও! কিন্তু বন্ধু, দ্বিতীয় সিটিংয়েও যে আমাকে উপস্থিত থাকতে হবে!
সত্যি এমন সময় সিঁড়িতে পদশব্দ শোনা গেল।
ঐ বোধ হয় আসছেন কৃষ্ণা দেবী—অতএব কিরীটী এবারে তুমি অন্তরালে আত্মগোপন করো—বলতে বলতে মৃদু হেসে কিরীটী উঠে পর্দার আড়ালে আত্মগোপন করে।
কৃষ্ণা এসে কক্ষে প্রবেশ করল।
কৃষ্ণার দেহসজ্জায়ও আজ নতুনত্ব পরিলক্ষিত হয়—তবে সহজ ও সরল। কৃষ্ণারও আজ সাধারণ গেরুয়া রংয়ের শাড়ি ও ব্লাউজ পরিধানে—মাথার পর্যাপ্ত চুল বেণীর আকারে পীনোন্নত বক্ষের দুটি পাশে লম্বমান।
এসো–এসো কৃষ্ণা! সাদর আহ্বান জানায় ডাক্তার।
আজকের sittingয়ের সময়টা এত রাত্রে করলেন কেন ডাঃ গুপ্ত?
উপায় ছিল না।
একই পরিবেশের মধ্যে একই প্রশ্ন করা হয় কৃষ্ণাকেও।
বোস–দাঁড়িয়ে কেন কৃষ্ণা!
কৃষ্ণা উপবেশন করে কক্ষের চতুর্দিকে একবার তাকায়।
কি দেখছো?
কিছু না।
Ready?
Yes!
ফুল?
কীট।
নর?
বানর।
চাদ?
সূর্য।
রাত্রি?
অন্ধকার।
পতঙ্গ?
আরশুলা।
দর্পণ?
ছায়া।
ড্যাগার?
ডেথ।
পূর্বের মতই দপ করে উজ্জ্বল আলো জ্বলে উঠলো ঘরে ও বাজনা বেজে ওঠে। ক্ষণপূর্বের আলোছায়ার রহস্য দূরীভূত হলো।
কৃষ্ণা শুনতে থাকে বাজনাটা, কি অদ্ভুত সব আবোল-তাবোল প্রশ্ন আজ আপনি করছিলেন বলুন তো ডাক্তার? জোরালো গলায় কৃষ্ণা প্রশ্ন করে।
সুকুমার মৃদু মৃদু হাসতে থাকে, কৃষার প্রশ্নের কোন জবাব দেয় না।