এমন সময় পূর্ব-পরিচিত সেই পাঠানটি কক্ষে প্রবেশ করে উপবিষ্ট পাঠানকে দেখে সসম্রমে দাঁড়িয়ে পড়ে, আপ–
হাঁ, কুছ পাত্তা মিলা ফৈয়াজ?
আভিতক ঠিক ঠিক পাত্তা নেহি মিলা জনাব। কৌসি ত ম্যায় কর রাহা হুঁ।–
কর রাহা হুঁ–কর রাহা হুঁ! ও বাত ত বহুৎ দফে শুন চুকা। ফিরভি শুননা নেহি চাতা! জলদি হামে ও মিলনা চাহি, সমঝা—
লেকেন–
দেখো আউর দশ রোজ তুমহে time দিয়া যায় গা। দশ দিনকা অন্দর-অন্দর নেহি ও সামানকো ফায়সলা কর সেকে ত, হামেভি দোসরা কই নওজোয়ান কো এ কামকে লিয়ে ভেজনা পড়ে গা, সমঝা?
জি—
আচ্ছা ত ম্যায় চলতা। রূপেয়াকা কোই জরুরৎ হো ত—
নেহি—
পাঠান ঘর হতে নিষ্ক্রান্ত হয়ে গেল।
ফৈয়াজ ঘরের মধ্যে পায়চারি শুরু করে। নিম্নস্বরে আত্মগতভাবে বলে, ওহি—জরুর ওহি হোগি। খপসুরৎ লেড়কী—
***
ডাঃ গুপ্তর চেম্বার।
ডাক্তারের চেম্বারে আজ বিশেষ পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয়। সমগ্র কক্ষটি, দেওয়াল হতে শুরু করে মেঝে আসবাবপত্র সব কিছু কালো কাপড়ে ঢেকে দেওয়া হয়েছে। ডাক্তারের টেবিলটির ওপরেও কালো টেবিলক্লথ বিস্তৃত এবং সেই টেবিলের উপরে সাদা হাড়ের তৈরী একটি অপূর্ব প্রতিমূর্তি : একটি পুরুষ সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, পশ্চাৎ হতে একটি নারীমূর্তি পুরুষটির পৃষ্ঠদেশ লক্ষ্য করে একটা তীক্ষ্ণ ছোরা তুলেছে।
ঘরের এক কোণায় জ্বলছে কেবল একটি লাল আলো স্বল্পশক্তির। রক্তাভ সেই আলোর দ্যুতি সমগ্ৰ কক্ষখানিকে যেন ভৌতিক এক বিভীষিকায় থমথমে করে তুলেছে। টেবিলের একধারে লাউডস্পীকার-সংযুক্ত একটা গ্রামোফোনে একটি রেকর্ড প্লেটের ওপরে বসানো। সাউণ্ড বক্সটাও রেডি করা আছে, মুহূর্তে ইচ্ছামত রেকর্ডটি বাজানো চলতে পারে।
ডাক্তার মধ্যে মধ্যে হাতঘড়িটা দেখছে।
ঢং ঢং করে রাত্রি নয়টা বাজল। সুইংডোরে মৃদু করাঘাত শোনা গেল, আসতে পারি?
আসুন।
কক্ষে এসে প্রবেশ করল কাবেরী।
সাদা জরির পাড় দেওয়া কালো সিল্কের একখানি শাড়ি পরিধানে, গায়ে কালো রংয়ের সাদা জরির বর্ডার দেওয়া টাইট-হাতা ব্লাউজ। মাথার চুল বেণীবদ্ধ, বক্ষের দুপাশে লম্বমান।
এ কি, ঘরে এমন আলো কেন?
বোস কাবেরী। ঐ চেয়ারটার ওপরে আরাম করে বোস।
কাবেরী নির্দিষ্ট চেয়ারটায় উপবেশন করে।
আবছা আলো-আঁধারিতে অস্পষ্ট ছায়ার মত ডাঃ সুকুমারকে দেখা যায়, গায়ে বোধ হয় একটা কালো অ্যাপ্রন। অ্যাপ্রনটার বুকের কাছে সোনালী জরি দিয়ে বীভৎস একটা ড্রাগনের মূর্তি তোলা।
ডাঃ গুপ্ত! ভীত একটা শঙ্কিত সুর যেন কাবেরীর কণ্ঠ হতে বের হয়।
Feeling nervous?
নার্ভাস! না–মানে–
We wont take much time কাবেরী। আজ কয়েকটা প্রশ্ন পর পর তোমাকে করে যাবো, তুমি প্রশ্নের পিঠে পিঠে যেমন মনে হবে জবাব দিয়ে যাবে, বুঝতে পেরেছো?
ক্ষীণকণ্ঠে জবাব দেয় কাবেরী, হুঁ।
বেশ। Ready?
Ready!
ফুল?
গন্ধ।
কীট?
পতঙ্গ।
নর?
নারী।
চাঁদ?
জ্যোৎস্না।
রাত্রি?
দিন।
পতঙ্গ?
পাখী।
দর্পণ?
প্রতিচ্ছায়া।
ড্যাগার?
সোর্ড।
প্রশ্নোত্তরের পর কাবেরীর সর্বশরীরকে যেন অসহ্য একটা ঘুমের ক্লান্তি ও শৈথিল্য আচ্ছন্ন করে ফেলে। যে চেয়ারটার ওপরে কাবেরী এতক্ষণ বসেছিল, সেই চেয়ারটারই গায়ে অবশভাবে শরীরটা এলিয়ে দেয় ধীরে ধীরে।
ডাঃ সুকুমার চেয়ারের ওপরে এলায়িত কাবেরীর সামনে আরো একটু এগিয়ে এসে দাঁড়ায়।
কাবেরীর চোখের পাতা দুটো নিমীলিত।
সুকুমার কিছুক্ষণ চেয়ারের ওপরে এলায়িত, মুদ্রিত চক্ষু কাবেরীর প্রতি চেয়ে থেকে ধীরে মৃদুকণ্ঠে ডাকে, মিস্ চৌধুরী! কাবেরী দেবী!
উঁ! ক্ষীণকণ্ঠে সাড়া দেয় কাবেরী।
খুব ক্লান্তি বোধ করছে, না?
হ্যাঁ, ঘুম আসছে—
ঘুমাও, ঘুমাবার চেষ্টা কর। হাঁ ঘুমাও–
একাগ্র তীক্ষ্ণদৃষ্টি ডাঃ সুকুমারের চোখে। অন্ধকারে জন্তুর চোখের মত জ্বল জ্বল করে ডাক্তারের চোখের মণি দুটো জ্বলছে যেন। গভীর অন্তর্ভেদী দৃষ্টি, কিন্তু পাথরের মতো স্থির, অচঞ্চল।
Sleep-sleep Kaberi!
কাবেরীর মাথাটা আরো একটু ঝুলে পড়ে।
ডাক্তারের কণ্ঠস্বর আবার শোনা যায়, কাবেরী?
উঁ! বহুদূর হতে ক্ষীণ কণ্ঠস্বর ভেসে এলো আবার।
এই পৃথিবীতেই এমন একটা জায়গা আছে যেখানে ছয় মাস থাকে দিনের আলো আর ছয় মাস থাকে রাত্রির জমাট কালো অন্ধকার। চারিদিকে শুধু জমাটবাঁধা ঠাণ্ডা বরফ। হু-হু করে বইছে যেখানে অবিশ্রাম হিমতীক্ষ্ণ ক্ষ্যাপা এলোমেলো হাওয়া। কোথাও সেখানে ফুলের কোন সমারোহ নেই-বর্ণের সাত রঙের খেলা প্রজাপতির মন ভোলানো অস্তিত্ব নেই। নেই মধুপের মধুগুঞ্জন। শীল মাছ, শ্বেত ভল্লুক আর বড় বড় শিংওয়ালা হরিণ। জনহীন জমাটবাঁধা বরফের সেই নিঃশব্দ নির্জনতায় মাঝে মাঝে শোনা যায় শ্বেত ভল্লুকের ক্ষুধার্ত চিৎকার—
কথা বলতে বলতে ইতিমধ্যে একসময় ডাক্তার পার্শ্বেই রক্ষিত অ্যাপ্লিফায়ার সংযুক্ত গ্রামোফোনে, ইংরেজী শব্দময় বাজনার একটা রেকর্ড যেটা আগে বসানো ছিল, সেটা চালিয়ে দিয়ে আবার বলতে থাকে? আহারের কোন সংস্থান নেই নেই কোন খাদ্যবস্তু, একমাত্র ঐ শীল মাছ ছাড়া। তাই ওদেশের লোকেরা তীক্ষ্ণ ধারালো ছোরা চালিয়ে শীল শিকার করে, হরিণ শিকার করে—ছুরি দিয়ে ফালি ফালি করে রক্তাভ হাতে
সহসা রেকর্ড বেজে উঠলো মুহূর্তে যেন। ঝম্ ঝম্ করে তীব্র বাজনার শব্দ ঝঙ্কৃত, শায়িত করে তোলে সমগ্র কক্ষখানিকে মুহূর্তে।