কাবেরী হন হন করে রাস্তা ধরে হেঁটে চলেছে। পিছনদিকে ফিরে তাকাবারও যেন কাবেরীর সময় নেই। কেবল মধ্যে মধ্যে রেডিয়াম দেওয়া ঘড়িটার উজ্জ্বল লেখাগুলোর দিকে তাকায়। কাবেরী পিছনপানে তাকালে দেখতে পেত বেশ কিছুটা দূরত্ব রেখে একটা কালো। রংয়ের গাড়ি নিঃশব্দে শ্লথগতিতে ওকে পিছু পিছু অনুসরণ করে চলেছে।
থিয়েটার রোড পার হয়ে সার্কুলার রোড ও পার্ক স্ট্রীট যেখানে এসে মিশেছে সেখানে চৌমাথার সামনে দাঁড়িয়ে এদিক ওদিক তাকাতেই একটা সবুজ রংয়ের ফুইড় ড্রাইভ ফোর্ডগাড়ি কাবেরীর পাশটিতে এসে দাঁড়াল, গাড়ির চালক সুবিমল।
মৃদুকণ্ঠে সুবিমল আহ্বান জানায়, এসো।
দরজাটা খুলে যায় গাড়ির, কাবেরী গাড়ির মধ্যে উঠে বসে।
গাড়ি আবার চলতে শুরু করে।
পশ্চাতের গাড়িটা এতক্ষণ কিছুটা দূরত্ব বাঁচিয়ে দাঁড়িয়েছিল, সেটাও এবারে চলতে শুরু করে ওদের গাড়িটাকে অনুসরণ করে।
এত দেরি হল যে? ভাবছিলাম ভুলে গেলে বুঝি!
মৃদু হাসি জেগে ওঠে কাবেরীর ওষ্ঠপ্রান্তে, ভুলিনি, ডাক্তারের সঙ্গে কথায় কথায় দেরি হয়ে গেল।
ডাক্তার যে বড্ড ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠছে বলে মনে হচ্ছে।
ছিঃ, কি যে বল! লোকটা সত্যিই ভাল, I like him.
দেখো, বেশী ভাল লাগলে দেখা যায় ভালবাসায় পরিণত হয় কিন্তু—
তোমরা পুরুষরা ভারী jealous!
আর তোমরা মেয়েরা ভারী উদার, নয়?
আকাশে ইতিমধ্যে কখন কালো কালো মেঘ ঘন হয়ে উঠেছে। একটা ঠাণ্ডা বাতাস বইতে শুরু করেছে। কালো মেঘের বুকে বিদ্যুতের চকিত আলোর ঝলকানিও লক্লকিয়ে গেল দুচারবার।
বৃষ্টি আসবে নাকি?
ক্ষতি কি আসুক না-সুবিমল জবাব দেয়।
কোথায় চলেছো?
যেদিকে দুচক্ষু যায়। সত্যি আর ভাল লাগে না, এই লুকোচুরি আর অন্তহীন এই প্রতীক্ষ্ণ। চল সোজা গাড়ি চালিয়ে চলে যাই পৃথিবীর কোন এক নির্জন প্রান্তে বা—
তারপর?
তারপর বেঁধে নেবো ছোট একখানি ঘর, নিরজনে তোমাতে আমাতে বাঁধিব বাসা—
বৃষ্টি শুরু হয়, উইণ্ড-স্ক্রীনের উপরে বৃষ্টির ছাঁট এসে পড়ছে।
হঠাৎ সুবিমল ডাকে, প্রিয়া?
ও কি!
বাধা দিও না প্রিয়া, বাধা দিও না, ডাকার নেশায় পেয়েছে আজ আমায়—
রাত অনেক হলো, এবারে ফিরে চল—
হোক, শেষ হয়ে যাবে আজকের এই রাত্রি, আবার আসবে রাত্রি, রাত্রির পর রাত্রি। এমনি কত রাত্রি পার হয়ে যাবে আর আমরা চলবো এগিয়ে বন্ধনহীন যাত্রী। সেই কবিতাটি জান—
পথ বেঁধে দিল বন্ধনহীন গ্রন্থি,
আমরা দুজন চলতি হাওয়ার পন্থী
* * *
নাই আমাদের সঞ্চিত ধনরত্ন
নাইরে ঘরের লালন-ললিত যত্ন।
পথপাশে পাখি পুচ্ছ নাচায়,
বন্ধন তারে করি না খাঁচায়,
ডানা-মেলে-দেওয়া মুক্তি প্রিয়ের
কূজনে দুজনে তৃপ্ত
আমরা চকিত অভাবনীয়ের
ক্কচিৎ কিরণে দীপ্ত।
হঠাৎ সোঁ সোঁ শব্দে হাওয়া বইল, ঝমঝম্ বৃষ্টি হলো শুরু।
গাড়ির কাচটা তুলে দিতে দিতে কাবেরী বলে, জোরে বৃষ্টি নামল যে—
নামুক। নামুক–আকাশ ভেঙে নামুক–
বাইরে ঝমঝম করে বৃষ্টি পড়ছে, সোঁ সোঁ করে বইছে ক্ষ্যাপা হাওয়া। নিজের ঘরের খোলা জানালার সামনে দাঁড়িয়ে সঞ্জীব চৌধুরী ক্রাচে ভর দিয়ে কবিতা আওড়াচ্ছেন। ঝোড়ো হাওয়ায় রুক্ষ এলোমেলো বড় বড় চুলগুলো উড়ছে। ঘরের কাগজপত্র, পর্দা উড়ে উড়ে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে। সঞ্জীব চৌধুরী আবৃত্তি করছেন নিম্নস্বরে—
A dungeon horrible, on all sides round,
As one great furnace flamed; yet from those flames
No light, but rather darkness visible.
Served only to discover sights of woe,
Regions of sorrow, doleful shades, where peace
And rest can never dwell, hope never comes
That comes to all; but torture without end–
ঘুমাতে যায় নি অত রাত্রেও কৃষ্ণা, বাইরের ঘরে একাকী চুপটি করে বসে, একটা বাংলা উপন্যাস পড়ছিল কাবেরীর প্রতীক্ষ্ণয়।
এত রাত হয়ে গেল, এখনো কাবেরী ফিরে এলো না!
বইটা সোফার উপরে রেখে দিয়ে জানালাপথে গিয়ে দেখে এলো একবার, কাবেরী আসছে কিনা। সঞ্জীবের আবৃত্তি থেমে গিয়েছে, শোনা যাচ্ছে বেহালার সুর। সঞ্জীব বেহালা বাজাচ্ছেন।
দরজায় মৃদু করাঘাত শোনা গেল।
কে?
দিদি আমি কাবি, দরজাটা খোল।
কৃষ্ণা এগিয়ে গিয়ে দরজাটা খুলে দিতেই কাবেরী এসে কক্ষে প্রবেশ করল।
কাবেরীর সর্বাঙ্গ ভিজা।
এত রাত করলি কেন?
হঠাৎ বৃষ্টি নামল দেখে ডাক্তার গুপ্ত আসতে দিলেন না। বলতে বলতে কাবেরী এগিয়ে যায় শয়নকক্ষের দিকে।
কাবি?
কি? কাবেরী ফিরে দাঁড়ায় কৃষ্ণার ডাকে।
কটা রাত হয়েছে খেয়াল আছে কি?
হাতে যখন ঘড়ি আছে এবং চোখের দৃষ্টিও যখন নষ্ট হয়ে যায় নি এখনো—
কাবেরী! কৃষ্ণা তীক্ষ্ণ চাপা কণ্ঠে ডেকে ওঠে।
দেখো দিদি—ফিরে দাঁড়ায় কাবেরী, আমার ব্যাপার নিয়ে তুমি একটু কম মাথা ঘামালেই সুখী হবো, mind your own business! বলে দৃঢ় পদবিক্ষেপে কাবেরী কক্ষান্তরে অদৃশ্য হয়ে গেল।
বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে কাবেরীর গমনপথের দিকে কৃষ্ণা।
পাশের ঘরে সঞ্জীবের বেহালা সুরের ঝঙ্কা তুলেছে তখন। কড়কড়াৎ শব্দে মেঘের হুঙ্কার চারিদিক সচকিত করে গেল।
***
তাজ হোটেলে সেই রাত্রে।
দামী স্যুট পরিধানে এক দীর্ঘকায় পাঠান অধীর আগ্রহে একটি চেয়ারের উপরে বসে ঘন ঘন বন্ধ দরজাটির দিকে তাকাচ্ছে আর মণিবন্ধের ঘড়ি দেখছে।