ভৃত্য জগদেও এসে কক্ষে প্রবেশ করল।
দুকাপ চা, জলদি।
ভৃত্য জগদেও আদেশ পালনের সম্মতি জানিয়ে চলে গেল।
অবশ্য কাজের জন্যই আপনারা এখানে আসেন, কিন্তু কাজের মধ্য দিয়ে যে আলাপপরিচয়টা আমাদের মধ্যে গড়ে উঠেছে, তাকেও তো আপনি অস্বীকার করতে পারেন না। পারেন কি, বলুন?
না। মৃদু হাস্যে কৃষ্ণা জবাব দেয়।
তাহলেই দেখ, সামাজিক জীবনটাকে অস্বীকার করতে আমরা কেউই পারি না। তার অবশ্য আরো একটা কারণ আছে, আমাদের প্রত্যেকেরই জীবনের অনেকখানি জ্ঞাতেই হোক বা অজ্ঞাতেই হোক, ঐ সহজ সামাজিকতাটাই জুড়ে আছে।
হয়ত আপনার কথাই ঠিক ডাঃ গুপ্ত।
হয়ত কেন বলছো কৃষ্ণা, তোমার টেলিফোন অফিস ও সেখানকার ডিউটি দেওয়া ছাড়া তোমার কি একটা বাইরের সামাজিক জীবন নেই? কোথাও বেড়াতে যাও না, বন্ধু বান্ধবীদের বাড়ি, আত্মীয়স্বজনের বাড়ি, পার্টি, উৎসব বা সিনেমা থিয়েটার।
একমাত্র অফিসের কাজ ছাড়া বাইরে বড় একটা আমরা বেরই হই না। কচিৎ কখনও ন-মাসে ছ-মাসে হয়ত এক-আধদিন সিনেমায় যাই—আর বন্ধু বা বান্ধবী নেই বললেই চলে।
বল কি! কখনো কি ইচ্ছা হয় না কারও সঙ্গে দুদণ্ড বসে আলাপ করতে, লেক বা গঙ্গার ধারে বা অন্য কোথাও বেড়াতে যেতে?
হয়, নির্জন গঙ্গার উপকূলে অথবা কোন নিরালা জায়গায় চুপটি করে একা একা এক এক সময় বসে থাকতে ইচ্ছা করে।
আচ্ছা কোন বন্ধু বা বান্ধবীই কি তোমার নেই?
বন্ধু বা বান্ধবীর কথা বলতে যেমন বইয়ে পড়ে থাকি বা শুনে থাকি তেমন কারও সঙ্গেই ঘনিষ্ঠভাবে আলাপ পরিচয় তো আমার নেই—
বর্তমানে নেই, না পূর্বেও কোনদিন ছিল না?
এখনও নেই—আগেও ছিল না।
সে রকম ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব না হয় কোনদিন কারও সঙ্গে ছিল না, কিন্তু পরিচয়?
একটু যেন ইতস্তত করে কৃষ্ণা এবারে জবাব দেয়, না।
জগদেও ট্রেতে করে চা নিয়ে এল।
চায়ের একটা কাপ নিজে তুলে নিয়ে অন্যটা কৃষ্ণার দিকে এগিয়ে দিতে দিতে সুকুমার বলে, চা নাও—
তারপর হঠাৎ মৃদু হেসে সুকুমার বলে ওঠে, দেখেছ ইতিমধ্যে কখন এক সময় আপনাকে তুমি বলতে শুরু করেছি–
তাতে কি হয়েছে, বয়সে তো আপনার থেকে কত ছোেট, এবার থেকে আপনি আমাকে তুমিই বলবেন–
এ অধিকারটুকু যখন দিলে, আর একটা ছোট্ট অনুরোধ জানাই—
অনুরোধ বলছেন কেন, বলুন না কি বলবেন?
পরশু শনিবার প্রাচীতে খুব ভাল একটা বই আছে, যাবে?
একটু ইতস্তত করে কৃষ্ণা।
অবশ্য আপত্তি যদি থাকে—
না—না। পরশু তো আমার off-dutyই আছে, বেলা ৫টার পর থেকে অসুবিধা হবে না।
বেশ, তবে সেই কথাই রইলো, তুমি এখানেই এসো–ছটায় শো। চন্দ্রিমা কাফেতে we will have our tea—তারপর সেখান হতে যাব সিনেমায়।
সুইংডোরের ওপাশ হতে কাবেরীর কণ্ঠস্বর সহসা ভেসে এল, আসতে পারি কি?
যুগপৎ দুজনই চমকে ওঠে।
ঠিক এমনি সময় চেম্বারের দেওয়াল-ঘড়িতে ঢং ঢং করে রাত্রি নয়টা ঘোষণা করলে।
কৃষ্ণা তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়ায়, উঃ! রাত নটা বাজে, আমি যাই।
আসুন, আসুন কাবেরী দেবী।
ডাঃ সুকুমার সাদর আহ্বান জানায়।
কৃষ্ণা সুইংডোর ঠেলে বের হয়ে যায়, কাবেরী এক পাশে সরে দাঁড়ায়, ক্ষণেকের জন্য উভয়েরই চোখাচোখি হয়।
কাবেরী দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয়।
কৃষ্ণা হন্ হন্ করে বের হয়ে যায়।
কাবেরী কমধ্যে প্রবেশ করলো।
কাবেরীর পরিধানে আজ অতি সাধারণ সাজসজ্জা। গেরুয়া রংয়ের খদ্দরের শাড়ি, লাল শাড়ির পাড়, গায়ে লাল রক্তবর্ণ ভয়েলের জামা। মাথার চুল বর্মিজ প্যাটার্নে বাঁধা। হাতে একগাছি করে সরু সোনার চুড়ি। দুই ভূর মাঝখানে বড় একটি কাজলের টিপ ও চোখের কোণে সূক্ষ্ম সুর্মার টান।
বসুন কাবেরী দেবী—
বসতে বসতে কাবেরী বলে, আজ প্রথমেই একটা প্রতিবাদ জানাবো ডাঃ গুপ্ত–
প্রতিবাদ? স্মিতহাস্যে তাকায় সুকুমার কাবেরীর হাস্যোচ্ছল মুখের দিকে।
হাঁ প্রতিবাদ। আপনার চাইতে বয়সে আমি অনেক ছোট, আপনি আমাকে এবার থেকে তুমি বলবেন, আপনি বলে আর কথা বলতে পারবেন না।
বেশ তো। কিন্তু আধুনিক সমাজে আজ ঐটাই প্রচলিত যে—
তা হোক। তাছাড়া আমাদের পরস্পরের এতদিনকার পরিচয়েও কি অপরিচিতের দূরত্ব বা সঙ্কোচটা কেটে যায় নি?
অন্তত আমি তো কেটে গিয়েছে বলে মনে করি।
একটু পরে সুকুমার আবার বলে, কৃষ্ণা দেবীও আজ আমাকে সেই অনুরোধই জানিয়েছেন।
তাই নাকি!
হ্যাঁ।
তাহলেই দেখুন আমরা দুজনেই কেউ আপনার ঐ আপনি সম্বোধনটা সহজভাবে নিতে পারছিলাম না। Businessয়ের ব্যাপারে টাকাটা না নিলে চলবে না যখন নিতেই হবে, কিন্তু এটা নিশ্চয়ই businessয়ের বাইরে পড়বে, কি বলেন? আমাদের সামাজিক সম্পর্কটা
বেশ তাই হবে।
আজ আমার sittingয়ের বিষয়বস্তু কি বলুন?
বিশেষ কিছু না, কয়েকটা ছবি সম্পর্কে আপনার মতামত জানতে চাই আজ, it wont take much time!
ছবি! কিসের?
ঐ চেয়ারটার উপরে বসুন আগে—
কাবেরী উঠে গিয়ে নির্দিষ্ট চেয়ারটায় উপবেশন করে।
আচ্ছা এবারে আপনাকে আমি পর পর চারখানা ছবি দেখতে দেবো। ছবিগুলো দেখে প্রথম দৃষ্টিতেই আপনার যেমন মনে হবে বলে যাবেন, কেমন?
বেশ।
দেখুন এই ছবিটা–কি দেখছেন?
ছবিটা হাতে নিয়ে দেখতে দেখতে কাবেরী বলে, দুটি বৃদ্ধ—একেবারে থুড়থুড়ে বুড়ো, পরস্পরের পিঠের সঙ্গে পিঠ লাগিয়ে বসে আছে। কি রোগা বুড়ো দুজন! মনে হয় যেন দুর্ভিক্ষের দেশ থেকে উঠে এসেছে। ভাসা ভাসা উদাস চোখের দৃষ্টি।