ঐ যে একটু আগে বললেন-duty first! জীবনে সর্বক্ষণ যদি কেবল dutyকেই first preference দিতে হয়, আপনি কি মনে করেন না তাতে অনেক ক্ষেত্রেই জীবনের অনেক বড় আনন্দকে বাদ দিতে হয়?
কেন? তা হবে কেন?
তা ছাড়া কি? মানুষের জীবনটা কি কেবল bundle of duties-ই? কেবল কর্তব্য আর কাজ করেই যাবো?
তা তো ঠিক আমি বলি নি মিস্ চৌধুরী। বলেছি আগে কর্তব্য। তার মানে এ নয়, জীবনের আনন্দটুকু বাদ দিয়ে কেবল কর্তব্যই করে যাবো—কেবল কাজই করে যাবো।
তাহলে অমন সুন্দর গানটা শোনা যাচ্ছিল, আপনি বন্ধ করে দিলেন কেন? কতক্ষণই বা সময় লাগত গানটা শেষ হতে!
তা নয় মিস্ চৌধুরী, আপনাকে আমি একটা কাজের জন্য আসতে বলেছি, আপনার সময়ের দাম আছে, তাই–
কৃষ্ণা হাসতে থাকে।
হাসছেন যে? সুকুমার প্রশ্ন করে।
আপনি ঠিক আমার বাবার মত। Duty সম্পর্কে he is so sincere—একটি মুহূর্তও তিনি কখনো অলসভাবে কাটান না।
আপনার বাবার সঙ্গে একদিন পরিচয় করবো।
না না—না–কতকটা যেন নিজের অজ্ঞাতেই আর্তস্বরে বলে ওঠে কৃষ্ণা। ডাক্তার একটু। বিস্মিত হয়।
তিনি—
না, তিনি বাইরের কারোর সঙ্গে কখনো কথাবার্তা তো দূরে থাক, দেখাশুনা পর্যন্ত করেন। এমনকি আমাদের দু বোনের সঙ্গেও দিনান্তে একটি দুটির বেশী কথা বলেন না।
কেন? বিস্মিত ডাক্তার প্রশ্ন করে।
কৃষ্ণা প্রসঙ্গটা তাড়াতাড়ি চাপা দিয়ে বলে ওঠে, সে কথা থাক। আজ কি করতে হবে বলুন।
ডাক্তার বুঝতে পারে, যে কোন কারণেই হোক কৃষ্ণা তার পিতার সম্পর্কে কোন আলোচনাই করতে ইচ্ছুক নয়।
অগত্যা ডাক্তার এগিয়ে গিয়ে অদূরে দেওয়াল-আলমারিটার ড্রয়ার খুলে, একটা খামের মধ্যে ভরা খানকয়েক হাতে আঁকা বিচিত্র ছবি বের করে আনে।
কৃষ্ণা প্রশ্ন করে, কি ওগুলো?
ডাক্তার বলে, ছবি। এবারে আপনি ঐ চেয়ারটার উপরে উঠে গিয়ে বসুন। এবার কাজ শুরু করা যাক।
ডাক্তারের হাতে খানকয়েক হাতে আঁকা ব্ল্যাক এণ্ড হোয়াইটের ছবি।
কৃষ্ণার চোখে-মুখে একটা কৌতুক ও আগ্রহ যেন স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। ছবিগুলো হাতের মধ্যে ধরে সুকুমার বলে, আজকের আমাদের sittingয়ের বিষয়বস্তু হচ্ছে এই ছবিগুলো। এই ছবিগুলো এক এক করে আপনাকে দেখতে বলবো এবং ছবিগুলো দেখে ছবিগুলোর বিষয়বস্তু সম্পর্কে প্রথম দৃষ্টিপাতেই যেমন যেমন আপনার মনে হবে বলে যাবেন—আমার বক্তব্যটা বুঝতে পারছেন তো?
কৃষ্ণা মৃদু হেসে ঘাড় নেড়ে জানায়, হাঁ।
কৃষ্ণা যে চেয়ারটার উপরে উপবেশন করেছে ঠিক তার সামনে, প্রলম্বিত একখানা প্রমাণ দর্পণে প্রতিবিম্বিত হয়েছে তার সর্বাঙ্গীণ ছায়া।
কৃষ্ণা সুন্দরী নয় শুধু, রূপে তিলোত্তমা যেন।
কৃষ্ণার অল্প দূরে টেবিলটার উপরে ছবিগুলো রেখে, একখানা ছবি হাতে নিয়ে টেবিলটার উপরে অর্ধদণ্ডায়মান ও অর্ধউপবিষ্ট ভাবে ডাক্তার ছবিখানা এগিয়ে ধরলো কৃষ্ণার দিকে, বলুন এই ছবিটা দেখে, কি দেখছেন এই ছবিতে?
কৃষ্ণা ছবিখানা দেখতে দেখতে বললে, এ আবার একটা ছবি নাকি? থুড়থুড়ে বুড়ো মানুষের মত যেন মনে হচ্ছে কি দুটো বসে!
বলুন তারপর? বলতে বলতে ডাক্তার একটা নোটখাতায় কি সব লিখে যায় পেনসিল দিয়ে।
হাড়পাঁজরাগুলো জিরজির করছে, হাত-পাগুলো সরু সরু প্যাঁকাটির মত, বড় বড় চোখ, হাতের নখগুলো বাঁকানো বড় বিশ্রী–
আর কিছু?
আবার কি! বুড়োমানুষ না বলে ও দুটোকে—দুটো বাঁদরও তো বলতে পারেন। দুটো সাপও বলতে পারেন-গোলকধাঁধাও একটা বলতে পারেন।
ছবিখানা কৃষ্ণার হাত হতে নিয়ে দ্বিতীয় ছবিটা কৃষ্ণার দিকে এগিয়ে দিতে দিতে সুকুমার বললে, বেশ, এই নিন দ্বিতীয় ছবিখানা, বলুন এ ছবিটায় কি দেখছেন?
ছবিখানা দেখতে দেখতে কৃষ্ণা বলে, চমৎকার! এগুলো আবার কি? একটা বাদুড় না চামচিকে-মুখে একটা পোকা ধরেছে বোধ হয়, নিচে ঘাস, বুনো আগাছা না কতকগুলো কেঁচো কিলবিল করছে!
খাতায় নোট করতে করতে সুকুমার বলে, আর কিছু?
সত্যি বলুন না—চামচিকে না বাদুর ওটা?
ডাক্তার মৃদু হেসে কৃষ্ণার হস্তধৃত ছবিখানা নিয়ে টেবিলের উপর রেখে তৃতীয় ছবিখানা এগিয়ে দিয়ে বললে, বেশ, এখন বলুন তো কি দেখছেন?
তৃতীয় ছবিখানা হাতে নিয়ে কৃষ্ণা ছবিটা দেখতে দেখতে বললে, Rare collections তো আপনার ছবিগুলো ডাঃ গুপ্ত!
কি দেখছেন বলুন?
একটা ঘাসের চাবড়া-না একটা মাটির ঢেলা—হ্যাঁ, তাই বলেই মনে হয়। উপরে কি একটা যেন বসে, একটা বোলতা না গুবরে পোকা! নিচে ওগুলো কি—আগাছা জন্মেছে অনেকগুলো, না?
বেশ। এই ছবিটায় কি দেখছেন এবারে বলুন? তৃতীয় ছবিখানা কৃষ্ণার হাত হতে নিয়ে চতুর্থ ছবিখানা এবারে ডাক্তার কৃষ্ণার হাতে তুলে দেয়।
কতকগুলো গোল সার্কেল (circle)—সার্কেলগুলোকে pierce করেছে একটা ধারালো ছোরা–
0. K.–আজ এই পর্যন্ত।
ছবিগুলো গোছাতে গোছাতে সুকুমার বলে, সোজা টেলিফোন অফিস থেকেই তো আসছেন, না?
হাঁ।
এক কাপ চায়ে আশা করি আপত্তি হবে না, কি বলেন মিস্ চৌধুরী?
না—না। এখন আবার চা-কৃষ্ণা আপত্তি জানায়।
টেবিলের উপরে রক্ষিত কলিং বেলটা বাজিয়ে ডাক্তার বলে, আমাদের হিন্দুশাস্ত্রে বলে দশ পা একত্র গেলেই নাকি বন্ধুত্ব হয়। দশ পা একত্রে আমরা না গেলেও অনেকদিন একত্রে বসে অনেক আলাপ আলোচনাই তো আমাদের পরস্পরের হয়েছে মিস্ চৌধুরী।