কিন্তু কে? কৃষ্ণা না কাবেরী?
কিরীটী হঠাৎ একদিন রাতে এলো। তারপর মনস্তাত্ত্বিক, সংবাদ কি তোমার clientদের?
এগুচ্ছে। ডাঃ গুপ্ত বলে।
হঠাৎ কিরীটীর টেবিলের উপরে নজর পড়ে। একটা ব্লটারের উপরে কত ভাবেই যে লেখা, কৃষ্ণা কাবেরী—কাবেরী কৃষ্ণা দুটি নাম।
মৃদু হাসি দেখা দেয় কিরীটীর ওষ্ঠপ্রান্তে, হুঁ! একটা কবিতা মনে পড়ে গেল ডাক্তার।
কবিতা? বিস্মিত সুকুমার বন্ধুর মুখের দিকে তাকায়।
হাঁ। একটু হেসে সুর করে কিরীটী বলে।
ভাল লাগে মোর দুটি নাম!
ভাল লাগে কানে কানে বলা–
আর মনে মনে জানা,
তটিনীর কলতান
ভাল লাগে খালি দুটি নাম।
লজ্জায় ডাক্তারের চোখে মুখে যেন রক্ত আবির ছড়িয়ে দেয়, যাঃ, কি যে বল!
কিরীটী বলে, বলি ভালই বন্ধু। তবে সত্য এই যা, সুন্দরী তরুণী, নির্জন একক সাহচর্য, দিনের পর দিন experiment বা studyটা তো মনের কথারও হতে পারে কি বল?
আঃ, কি আরম্ভ করলি বল্ তো! কাবেরী দেবীর আসবার সময় হয়েছে, এখুনি হয়ত এসে পড়বেন, যদি শুনতে পান–
আনন্দই পাবেন, তাছাড়া এসে পড়বেন নয়—পড়েছেন। ঐ শোন তাঁর লঘু পদধ্বনি পাষাণ সোপানবক্ষে। শোন—কান পেতে শোন—নহে, নহে মিথ্যা বা মনের কল্পনা।
সত্যি সিঁড়িতে লঘু পদশব্দ শোনা গেল। কেউ উপরে উঠে আসছে।
চলি বন্ধু—দেখা হবে পুনঃমৃদু হেসে কিরীটী ঘর হতে নিষ্ক্রান্ত হয়ে যায়।
কাবেরীর কণ্ঠস্বর সুইং-ড্ডারের ওপাশ হতে ভেসে এলো, ভিতরে আসতে পারি কি?
আসুন, আসুন কাবেরী দেবী।
সানন্দ আহ্বান শোনা গেল ডাক্তারের কণ্ঠে।
.
টেলিফোন অফিসের অপারেটিং রুম। কানে হেড়পিস লাগিয়ে দুবোন কাজ করছে। পাশাপাশি। মধ্যে মধ্যে একথা সেকথা আলোচনা হচ্ছে। দুই বোনের মধ্যে কথাবার্তা হচ্ছিল, বাইরে সন্ধ্যার তরল অন্ধকার ডানা মেলেছে।
কৃষ্ণা জিজ্ঞাসা করে হঠাৎ একসময় আলোচনার মধ্যে, ডাক্তার গুপ্তকে তোর কি রকম মনে হয় কাবি?
কাবেরী : তা মন্দ কি! বেশ ভাল লোক বলেই তো মনে হয়। একটু যা মিস্টিরিয়াস—সব সময় যেন ঠিক বোঝা যায় না।
কৃষ্ণা : একদিন আমাদের বাড়িতে চায়ের নিমন্ত্রণ করলে মন্দ হতো না—
কাবেরী? বাবাকে কি ভুলে গেলি দিদি!
হঠাৎ কৃষ্ণা হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে, মিস রেহানা এখনো তো এলো না। সোয়া সাতটা বেজে গেল।
কাবেরী বলে, আমারও তো রিলিফ মিস্ বোস এখনো এলো না।
এমন সময় দেখা গেল মিস্ রেহানা ও মিস্ বোস দুজনেই প্রায় আগে পিছে ঘরে এসে ঢুকছে।
কৃষ্ণা কাবেরী তাদের পরস্পরের ডিউটি মিস্ রেহানা ও মিস্ বোসের হাতে তুলে দিয়ে উঠে দাঁড়াল।
বাইরে সন্ধ্যার কলকাতা শহর আলোকসজ্জায় হাস্য ও লাস্যময়ী হয়ে উঠেছে তখন।
টেলিফোন অফিসের ঠিক গেটের সামনেই লাইটপোস্টের নিচে স্যুট পরিহিত একটি ভদ্রলোক, মাথায় ফেল্ট ক্যাপ বাঁ দিককার মুখের উপরে একটু টেনে গেটের দিকে দৃষ্টি দিয়ে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ধূমপান করছিল। ওদের দুবোনকে অফিস থেকে বের হতে দেখে যেন লোকটা সজাগ হয়ে ওঠে। কাবেরীর দৃষ্টি হঠাৎ স্যুট-পরিহিত লোকটার উপরে গিয়ে পড়ে। সে অলক্ষ্যে কৃষ্ণার গায়ে হাত দিয়ে চাপা কণ্ঠে ডাকে, দিদি
কি হলো আবার, থামলি কেন?
ওই যে লাইটপোস্টের নিচে দাঁড়িয়ে স্যুটপরা লোকটা, কিছুদিন ধরে লক্ষ্য করছি ও আমাদের প্রায়ই follow করে—
কি যে বলিস?
স্যুটপরিহিত লোকটি ততক্ষণে এক পা এক পা করে হাঁটতে শুরু করেছে।
হাঁ—I am sure about it. সেদিন রাত্রে ডিউটি সেরে ফিরছি—লোকটা ঠিক ঐ জায়গায় দাঁড়িয়েছিল। প্রথমটা তত মন দিই নি, পরে ট্রাম থেকে বাড়ির কাছে গিয়ে নেমেছি, রাত্রি তখন প্রায় এগারোটা। রাস্তা ও তার আশপাশ বেশ নির্জন। মনে হলো হঠাৎ, তখনও যেন লোকটা আমার পিছু পিছু আসছে। পিছন ফিরে থমকে দাঁড়ালাম। তাকিয়ে দেখতে পেলাম, কেবল ঐ লোকটা দূরে দাঁড়িয়ে। গাটার মধ্যে কেমন ছছ করে উঠলো।
নে নে চল, যত সব আজগুবী চিন্তা! আমার আবার ডাক্তার গুপ্তের ওখানে রাত আটটায় sitting আছে—তুই বাড়ি হ্যাঁ, আমি একেবারে sitting শেষ করে যাবো–
আজই রাত আটটায় sitting?
হ্যাঁ, রাত আটটায়।
আমারও তো sitting আছে আজ রাত নটায়–কাবেরী বলে।
ঢং ঢং করে ডাঃ গুপ্তর চেম্বারের সুদৃশ্য ওয়ালকটায় রাত্রি ঠিক আটটা ঘোষণা করলো। ডাঃ গুপ্ত একাকী চেম্বারের মধ্যে নিঃশব্দে কার্পেট-মোড়া মেঝের ওপরে পায়চারি করছে। এক-একবার ঘড়ির দিকে তাকায়।
তারপর এগিয়ে গিয়ে অদূরে স্ট্যাণ্ডের উপরে রক্ষিত রেডিও সেক্টা চালিয়ে দিল। গান শোনা যায় কলকাতা কেন্দ্রের।
আটটা বেজে ঠিক পাঁচ মিনিট। সুইং-ডোরের ওপাশ হতে নারীকণ্ঠ ভেসে এলো, আসতে পারি?
চট করে রেডিওটা বন্ধ করে দাঁড়ায় ডাক্তার, আসুন আসুন, কৃষ্ণা দেবী।
কৃষ্ণা কক্ষে এসে প্রবেশ করলো। বড় সুন্দর আজ মানিয়েছে সাধারণ একটি কালো রঙের শাড়ি ও টকে লাল রঙের একটা ব্লাউজ গায়ে কৃষ্ণাকে।
রেডিও বন্ধ করলেন কেন? বেশ সুন্দর গানটা হচ্ছিল—
Duty first—স্মিতভাবে ডাঃ সুকুমার জবাব দেয়।
তারপর তখনও কৃষ্ণাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বলে ওঠে, দাঁড়িয়ে রইলেন কেন, বসুন।
আমি আপনার কথা কিন্তু ঠিক মেনে নিতে পারলাম না ডাঃ গুপ্তহঠাৎ কৃষ্ণা বলে ওঠে।
বুঝতে পারলাম না আপনার কথা কৃষ্ণা দেবী।