সমীর রায় সকালে তার বাইরের ঘরে বসে ঐ দিনকার সংবাদপত্রটার ওপরে চোখ বুলোচ্ছে, বাইরে গেটের সামনে একটা গাড়ি থামবার শব্দ শোনা গেল। সমীর একটু কৌতূহলী হয়েই জানালার সামনে উঠে এসে দাঁড়াল। বাড়ির গেটের সামনে একটা মালবোঝাই ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে, ট্যাক্সির সামনে নরেন মল্লিক ড্রাইভারের সঙ্গে কথা বলছে।
নরেন! এ সময়ে হঠাৎ! কোন চিঠিপত্র না দিয়ে!
একটু পরেই নরেন এসে কক্ষে প্রবেশ করল।
নরেন তুই! হঠাৎ–
হঠাৎই। বর্মার ব্যবসা গুটিয়ে দিয়ে এলাম।
গুটিয়ে দিয়ে এলি? হঠাৎ
চলে এলাম আর ভাল লাগল না। কিন্তু তার আগে তোর চারককে বল, আমার চাকর মধু ট্যাক্সিতে আছে, মালপত্রগুলো নামিয়ে আপাতত কোথাও গুছিয়ে রাখবার জন্য হাত দিতে।
তা না হয় বলছি—কিন্তু—
ব্যস্ত হোস নে। সব বোলবো–
সমীর ভৃত্যকে ডেকে ট্যাক্সি থেকে সব মালপত্র নামিয়ে নিচের ভিজিটার্স রুমে আপাতত গুছিয়ে রেখে দিতে আদেশ দিল।
নরেন মল্লিকের চেহারাটা সত্যই দৃষ্টিকে আকর্ষণ করে। বাঙালীর মধ্যে সচরাচর এমন চমৎকার সুগঠিত, উঁচু, লম্বা, সুশ্রী দৈহিক গঠন বড় একটা দেখা যায় না। নরেন মল্লিকের বয়েস বর্তমানে উনপঞ্চাশ এবং বয়সের অনুপাতে দেহের কোথাও এতটুকু ভাঙনও ধরে নি। সমস্ত দেহ জুড়ে এখনো যৌবন যেন স্থির হয়ে আছে।
কেবল কপালের দুপাশের চুলে সামান্য পাক ধরেছে। গায়ের বর্ণ উজ্জ্বল গৌর। দাড়িগোঁফ নিখুঁতভাবে কামানো। প্রাণপ্রাচুর্যে ভরপুর। চঞ্চল, ক্রীড়াশীল ও কৌতুকপ্রিয় স্বভাব। নরেন মল্লিককে দেখলেই মনে হয়, সত্যিই যেন সে বেঁচে আছে। এবং পৃথিবীতে বাঁচবার সমস্ত রহস্যটুকুই যেন ওর করায়ত্ত।
.
দ্বিপ্রহরে আহারাদির পর নরেন ও সমীর মুখোমুখি বসে দুই বন্ধুতে সকালের কথারই জের চালাচ্ছিল। আজ রবিবার, আদালতও বন্ধ। ছুটি।
নরেন বলছিল, মোদ্দা কথা বন্ধু, I want to live the rest of my life, যদিও শাস্ত্রে বলেছে পঞ্চাশের পরেই বনং ব্রজেৎ, আমি স্বীকার করি না সে কথা। আমার ideal পুরুষ হচ্ছে বিখ্যাত ডাক্তার ও বৈজ্ঞানিক ভরেনহ। অর্থ না থাকলে বাঁচা যায় না। এতকাল সেই অর্থের ধান্ধায় ঘুরেছি, সময় পাই নি জীবনের দিকে তাকাবার, আজ অর্থ আমার করায়ত্ত, এবারে eat, drink and be merry! এবারে বাঁচতে চাই! So–
So? হাস্যোফুল ভাবে সমীর বন্ধুর দিকে তাকায়।
So একটা বাড়ি ও একটা গাড়ি সর্বাগ্রে প্রয়োজন; তারপর শুরু করবো আমার জীবন।
বাড়ি আর গাড়ি?
হাঁ। বর্তমান দুনিয়ায় বাড়ি, গাড়ি ও ব্যাঙ্ক-ব্যালান্সই আধুনিক কালে বাঁচবার প্রচেষ্টায় প্রথম তিনটি সোপান; শেষটি আমি সঙ্গে করেই এনেছি এবার, প্রথম দুটি তুমি সংগ্রহ করে দাও, শুরু করি আমি আমার জীবনের নতুন অধ্যায়।
বেশ!
বেশ নয়—একটি মুহূর্তও আর নষ্ট করবার মত হাতে নেই বন্ধু! জীবনের অনেকটা সময় চলে গিয়েছে অতএব আর অপেক্ষা নয়—বাড়ি তৈরী করবার ধৈর্য বা সময় আমার নেই। ৬০।৭০ হাজারের মধ্যে একটা বাড়ি ক্রয় করতে চাই আমি—আর a nice-looking carFord fluid-drive, ওলডমবিল বা স্টুডিবেকার—নিদেনপক্ষে হাম্বার বা রোভার-১২।
বেশ নয়—একটি মুহূর্তও আর নষ্ট করবার মত সময় হাতে নেই বন্ধু। জীবনের অনেকটা সময় একটা গাড়ি!
তারপর একটু থেমে বলে, দাঁড়াও, পার্ক সার্কাস অঞ্চলে একটা চমৎকার নব্যকেতার বাড়ি আমার এক ক্লায়েন্টের ডিসপোজালেই আছে, বাড়িটা ভালই—দোতলা, উপরে নীচে খান আষ্টেক ঘর, সামনে লন, পের্টিকো, পিছনেও ছোটখাটো একটা বাগান, গ্যারাজ, গেটের পাশে দারোয়ানদের থাকবার ঘর।
চমৎকার! দাম?
সেলামী নিয়ে বোধহয় হাজার ষাটেক পড়বে—মানে যার বাড়ি তিনি একটু বেকায়দায় পড়েই বাড়িটা বিক্রী করে দিতে চান, নইলে ও বাড়ি ধরে রাখলে হাজার আশি পর্যন্ত—
ডোন্ট ওরি, এখুনি ফোন কর কিন্তু ঐ সেলামীর কথা কি বলছিলে?
থাকতে মগের দেশে, অধুনা কলকাতার সংবাদ তো রাখ না! বাড়ির problem বর্তমানে এ শহরে যা হয়েছে! ঐ সেলামী হচ্ছে বাড়ি ভাড়া ও ক্রয়ের প্রথম সোপান। তা সেলামীও বলতে পার—আক্কেল সেলামীও বলতে পার কারণ প্রয়োজনটা যখন ক্রেতা বা ভাড়াপ্রার্থীর–
ঠিক আছে, ফোন কর।
বাড়ি দেখে নরেনের পছন্দ হয়ে গেল। সত্যি চমৎকার বাড়িটা। পরের দিনই বায়না করা হলো। এবং নির্দিষ্ট দিনে নতুন বাড়ি ও ফ্লুইড় ড্রাইভ একটা ফোর্ড গাড়ি কিনে নরেন মল্লিক গৃহপ্রবেশ করল। বাড়ির ফটকে নেমপ্লেট বসলো : শ্রীনরেন মল্লিক।
গেটের দারোয়ান বহাল হলো, খোট্টাই রামখেল সিং। আরো দুজন চাকর এলো, হরি আর যদু, পনের বছরের পুরাতন ভৃত্য মধু তো রইলই। ড্রাইভার নন্দুয়া এলো, পাচক উৎকলবাসী শ্রীমান জগন্নাথ। দামী দামী সাজসজ্জায় বাড়িঘরদোর ভরে উঠলো।
নিরহঙ্কার, সদালাপী স্বভাবের দরুন শীঘ্রই পাড়ায়, অভিজাত মহলে নরেন মল্লিকের নামটা এ-কান ও-কান হতে হতে দশ কানে ছড়িয়ে গেল। লম্বাচওড়া সুশ্রী চেহারা এখনো বিবাহাদি করে নি। বয়স যদিচ পঞ্চাশের কোঠায় চলেছে, এখনো অটুট স্বাস্থ্য ও যৌবনের প্রাচুর্যে ঢল ঢল, তার উপরে কাল্পনিক ব্যাঙ্ক-ব্যালান্সের গুজব, বাড়ি, গাড়ি এবং সর্বোপরি মিষ্টি সদালাপী অমায়িক ব্যবহার।
কলকাতার আধুনিক অভিজাত মহলে শীঘ্রই মুখে মুখে নরেন মল্লিক প্রসিদ্ধ হয়ে গেল। জাগিয়ে তুললো একটা রীতিমত সাড়া। অনেক অবিবাহিতা মেয়েদের মায়েরা নরেন মল্লিকের গৃহে প্রায়ই আনাগোনা করতে শুরু করলেন। আর এক শ্রেণীর মেয়ের মায়েরা আছেন, যাঁরা অল্পবয়সী ছেলে—জীবনে এখনো সুপ্রতিষ্ঠিত নয়, সেই সব পাত্রের চাইতে মধ্যবয়সী প্রতিষ্ঠিত ও অর্থবান পাত্রদের ঢের বেশী পছন্দ করেন, তাঁরাও অনেকে সেজেগুজে মেয়েদের নিয়ে নিয়মিত হাজিরা দিতে শুরু করলেন মল্লিক পারলারে।