করুণার কৃপাদৃষ্টি লাভের জন্য অনেক বেকার বড়লোকের সন্তানও স্বল্প আয়ে জীবনে প্রতিষ্ঠা খুঁজে বেড়াচ্ছে এমন তরুণের দল সর্বদা করুণার পিছনে পিছনে মধুলোভী ভ্রমরের মত গুনগুন রব তুলে ফিরছে তখন।
কিন্তু করুণার জননী মুখে কাউকে কিছু না বললেও মনে মনে কাউকেই ভবিষ্যৎ জামাতা হিসাবে পছন্দ করতেন না।
সঞ্জীব মাসখানেকের ছুটি নিয়ে সেবার কলকাতায় এসে নতুন একটা গাড়ি কিনে এক
অবিবাহিত ব্যারিস্টার বন্ধুর পাল্লায় পড়ে ক্লাবে ও নানা পার্টিতে যাতায়াত করছে।
ঐরকম এক পার্টিতেই সঞ্জীব আবৃত্তি করলে ও বাজিয়ে শোনালে বেহালা। করুণা যেচে এসে সঞ্জীবের সঙ্গে আলাপ করলে।
ক্রমে আলাপ-পরিচয়টা আরো ঘনিষ্ঠ হলো, পরস্পর পরস্পরের বাড়িতে যাতায়াত শুরু করলে। সঞ্জীব আরও এক মাসের ছুটি নিল। অবশেষে করুণার মা-ই একদিন সঞ্জীবের কাছে। বিবাহের প্রস্তাব করলেন কন্যার হয়ে।
সঞ্জীব মনে মনে যে কামনাটা ইদানীং ভীরু সঙ্কোচের সঙ্গে লালন করছিল, করুণার মায়ের প্রস্তাব শুনে অন্তরের সেই ভীরু বাসনা মুক্তির আনন্দে যেন দুকূল ছাপিয়ে গেল।
মৃদু সঙ্কোচের সঙ্গে সঞ্জীব বললে, কিন্তু মা, করুণা কি—
মৃদু হেসে করুণার মা বললেন, রুণার মন না জেনেই কি এ প্রস্তাব আমি তোমার কাছে করছি বাবা! তাছাড়া মেয়ে আমার এদিকে যতই সোসাইটির মধ্যে ঘুরে বেড়াক, ভীষণ লাজুক। আমি তো জানি রুণাকে।
***
যা হোক ঐ মাসেরই শেষে সঞ্জীব ও করুণার বিবাহ হয়ে গেল। এবং বিবাহের পরেই সঞ্জীব করুণাকে নিয়ে চা-বাগানে চলে গেল। দশ-পনের দিন যেতে-না-যেতেই কিন্তু করুণা বলতে শুরু করলে, এ কি ছাইয়ের জায়গা! মনের কথা বলবার একটা লোক নেই। না আছে ক্লাব, একটা হোটেল বা সিনেমা!
সঞ্জীব ভাবলেন, সত্যিই তো, অল্প বয়স করুণার, চিরদিন কলকাতার মত শহরে মানুষ। পাণ্ডব-বর্জিত এই বনজঙ্গলে তার মন টিকবেই বা কেন?
নিজে সঙ্গে করে সঞ্জীব রেখে এলেন করুণাকে কলকাতার বাড়িতে। ভৃত্য, চাকরানী, ড্রাইভার, বামুন নিযুক্ত হলো। করুণা মনের আনন্দে দিন কাটাতে লাগলো। হাতে অজস্র টাকা, বাড়ি, গাড়ি, সোসাইটিতে পজিশন করুণা তার নিজের খেয়ালখুশিতে মশগুল হয়ে উঠলো।
সঞ্জীব মধ্যে মধ্যে আসেন, ছয় সাত দিন থেকে যান। স্ত্রীকে যখনই নিজের কর্মস্থলে যাওয়ার কথা বলেন, করুণা মুখখানি ভার করে। সঞ্জীবের কেমন মায়া হয়, কিছু বলতে পারেন না।
বৎসর দেড়েক বাদে কৃষ্ণা ও কাবেরী যমজ দুটি মেয়ে হলো করুণার।
এবারে আবার সঞ্জীব করুণাকে সঙ্গে নিয়ে যেতে চাইলেন নিজের কর্মস্থলে, কিন্তু করুণা রাজী হলো না।
স্ত্রীর ব্যবহারে সঞ্জীব মনে বিশেষ আঘাত পেলেন এবারে, মুখে কিছু বললেন না—কিন্তু মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলেন, জীবনে আর কখনো স্ত্রীকে নিজের কাছে যেতে বলবেন না। থাক সে এখানে, যদি কখনো সে স্বেচ্ছায় যেতে চায় তাঁর কাছে, তবেই নিয়ে যাবেন নইলে নয়।
শাপে বর হল করুণার। আয়ার হাতে মেয়ে দুটির রক্ষণাবেক্ষণের ভার সঁপে দিয়ে করুণা তার পার্টি, ক্লাব নিয়েই হৈ হৈ করে সারাদিন বেড়াতে লাগল।
.
ব্যাঙ্কের জমানো টাকার সংবাদ বিবাহের পর থেকেই সঞ্জীব আর রাখতেন না, স্ত্রীর নামে ব্যাঙ্ক হতে টাকা তুলবার ক্ষমতা দিয়ে দিয়েছিলেন। বিবাহের বছর চারেক বাদে হঠাৎ একদিন সঞ্জীব আবিষ্কার করলেন ব্যাঙ্ক প্রায় শূন্য।
তাড়াতাড়ি ছুটে এলেন সঞ্জীব কলকাতায়। শুধু যে ব্যাঙ্ক শূন্য তা নয়, বহু জায়গায় ধারও হয়েছে করুণার প্রচুর। সেই ঠেলা সামলাতে গিয়ে একখানা বাড়ি বিক্রয় হয়ে গেল। তথাপি সঞ্জীব করুণাকে কিছু বললেন না।
দুটো বছরও তারপর গেল না—বাকী দুখানা বাড়িও দেনার দায়ে বিক্রি হয়ে গেল, সময় থাকতে করুণাকে কিছু না বলবার জন্যই। কিন্তু এবারে আর সঞ্জীব চুপ করে থাকতে পারলেন না।
একদিন স্ত্রীকে বললেন, করুণা, এতদিন তোমায় আমি কোন কথা বলি নি, কিন্তু আর বলে পারছি না, এবার থেকে যদি তুমি সাবধানে না চল, ভবিষ্যতে তোমায়ই অসুবিধায় পড়তে হবে।
করুণা স্বামীর দিকে বিলোল কটাক্ষ হেনে বললে, সোনার হরিণের দাম কি কখনো কমে?
তারপর স্বামীর দেহের উপরে এলিয়ে পড়ে হাসতে হাসতে বললে, তাই বলে কঞ্জুস নাম কিনতে পারবো না। তোমার স্ত্রীর societyতে একটা position আছে তো!
সমস্ত আঘাতই সঞ্জীব সহ্য করেছিলেন করুণার দিক থেকে কিন্তু শেষ ও চরম আঘাত এলো যখন তিনি একটা উড়ো চিঠি থেকে জানতে পারলেন, করুণা অরুণ নামে কোন এক তরুণ ব্যারিস্টারের সঙ্গে কুৎসিত জীবনযাপন করছে, তারই স্বোপার্জিত অর্থে।
গোপনে সংবাদ নিয়ে সঞ্জীব জানলেন চিঠির একটি বর্ণও মিথ্যা নয়। তথাপি করুণার প্রতি তার হৃদয়ভরা ভালবাসা তাঁকে রূঢ় হতে দিল না।
কেবল একখানা চিঠি লিখলেন, তিনি আসছেন—করুণা যেন প্রস্তুত থাকে, এবারে তাকে তিনি সঙ্গে নিয়েই আসবেন।
করুণা স্বামীর চিঠি পেয়েও এতটুকু বিচলিত হলো না, কারণ স্বামীর তার প্রতি যে কি প্রগাঢ় ভালবাসা সেটা তার অবিদিত ছিল না।
সেদিন সঞ্জীব আসবার একটু আগে সেই সম্পর্কেই করুণা ও অরুণের মধ্যে কথাবার্তা চলছিল।
কাবেরীকে কোলে নিয়ে স্বামীকে হঠাৎ কক্ষে প্রবেশ করতে দেখে করুণা চিৎকার করে আয়াকে ডাকল, আয়া—আয়া—