কাবেরী বলে, কিন্তু বাবা, একশ টাকাটা খুব বেশী নয় কি?
সঞ্জীব জবাব দেন, না। যে লোক সামান্য একটা অদ্ভুত খেয়ালের জন্য টাকা খরচ করতে রাজী থাকে, তার কাছে অর্থের মূল্যটা খুব বেশী নয় কাবেরী। তাছাড়া দিয়েই দেখ না দরখাস্ত, রাজীও তো হতে পারে। তাছাড়া লোকটা রাজী হয়ে যায় ভালইনচেৎ আমাদের ক্ষতিই বা কি?
কিন্তু বাবা—এতক্ষণে কৃষ্ণা কথা বলে।
আর কথা নয় কৃষ্ণা। তোমরা এখন যেতে পারো—সঞ্জীব কতকটা যেন মেয়েকে বাধা দিয়েই প্রসঙ্গটা থামিয়ে দিলেন।
বাপের প্রকৃতির সঙ্গে কৃষ্ণা কাবেরী যথেষ্ট পরিচিত, আর দ্বিরুক্তি না করে দুজনে কক্ষ হতে নিষ্ক্রান্ত হয়ে গেল।
***
মেয়েরা কক্ষ হতে নিষ্ক্রান্ত হয়ে গেলে সঞ্জীব চেয়ার হতে উঠে ক্রাচে ভর দিয়ে দিয়ে কক্ষের আলমারীটার সামনে এসে দাঁড়ালেন।
একটা ড্রয়ার খুলে বের করলেন একটা ফাইল—সেই ফাইলটা খুলতেই বের হলো ৩০/৩২ বৎসরের অপরূপ রূপলাবণ্যময়ী এক নারীর ফটো। ফটোটা চোখের সামনে তুলে ধরে কিছুক্ষণ অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে সঞ্জীব চৌধুরী চাপা স্বরে বলতে থাকেন, করুণা করুণা করুণা! চোখের কোণে দুফোঁটা জল বুঝি এসে জমা হয় বৃদ্ধ সঞ্জীবের। কিন্তু পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নেন সঞ্জীব চৌধুরী, তারপর তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ফটোটার দিকে তাকিয়ে চাপা কণ্ঠে বলে ওঠেন, You-You cruel heartless woman, you ruined my life! কিন্তু আজ? কেমন জব্দ, কেমন জব্দ করেছি তোমায়! আমার বুকভরা অফুরন্ত ভালবাসাকে একদিন দুপায়ে তুমি থেঁতলে দিয়েছিলে। নিষ্ঠুর পাষাণ হৃদয়ে তোমার তিলমাত্রও সাড়া জাগাতে পারি নি। কিন্তু আজ! কেমন জব্দ, কেমন জব্দ?…World is too big, নয়?
হঠাৎ পাগলের মতই হাঃ হাঃ করে হেসে ওঠেন সঞ্জীব চৌধুরী।
.
দীর্ঘ সতের বছর আগে—স্মৃতির পর্দায় আলোকপাত হলো।
হাঃ হাঃ করে একটি সুবেশধারী যুবক হাসছে। সুসজ্জিত একটি ড্রইংরুম। যুবকটির নাম অরুণ মল্লিক। অদূরে সোফার উপরে বসে সুন্দরী, সুবেশা সঞ্জীব চৌধুরীর তরুণী স্ত্রী করুণা।
না–না—হাসি নয়, সত্যি বলছি অরুণ, সে ভীষণ রেগে গিয়েছে। লিখেছে, শীঘ্রই নাকি আমাদের সে চা-বাগানে নিয়ে যাবে
After all the good old Sanjib is really a devoted husband. মিথ্যে তুমি ভয় পাচ্ছ রুণা। চা-বাগানে নিয়ে যাবে তোমার মত একজন সোসাইটি লেডিকে, চা-বাগানের সেই অন্ধকার জীবনে সে কখনই টেনে নিয়ে যেতে পারে না। সকলে মিলে আমরা তীব্র প্রতিবাদ করবো। Vehemently protest করবো।
কিন্তু এ কথাটা তোমরা ভোল কেন অরুণ, আমি তার বিবাহিতা স্ত্রী! তারই অধিকার সর্বাগ্রে–
বৃদ্ধস্য তরুণী ভার্যা!
Dont be naughty অরু। সে আমার স্বামী।
অস্বীকার করি না, তাই বলে সীমা লঙ্ন করা কি উচিত?
এমন সময় ছয় বছরের শিশুকন্যা কৃষ্ণা ঘরে এসে প্রবেশ করল।
কৃষ্ণি! কাবি কোথায়?
কাবি ওঘরে খেলছে মা!
মা মেয়েকে কাছে টেনে এনে কুঞ্চিত কেশরাশিতে সস্নেহে হাত বুলাতে থাকেন।
অরুণ বলে, তাছাড়া তোমার এই যমজ মেয়ে কৃষ্ণা কাবেরী, ওদের কথা একবারও কি ভাবছো রুণা? চা-বাগানের বনজঙ্গলে গেলে ওদের লেখাপড়া, মানুষ করা সম্ভব হবে বলে মনে করো? তোমার স্বামী মিঃ চৌধুরী তাঁর নিজ সন্তানের ভবিষ্যৎকে নিশ্চয়ই অবহেলা করবেন না।
মুশকিল তো আমার মেয়ে দুটিকে নিয়েই আরো হয়েছে অরুণ।
এমন সময় বাইরে কাবেরীর উল্লসিত কণ্ঠস্বর শোনা গেল, ওমা! দেখবে এসো বাবা এসেছে–
এ কি! উনি আজই এসে গেলেন নাকি! সবিস্ময়ে বলে ওঠে করুণা।
আমি তাহলে এখন চলি রুণা! আজকের পার্টির কথা ভোল নি তো?
না।
আসছো নিশ্চয়ই?
নিশ্চয়ই।
তা হলে চলি। পার্টিতে আবার দেখা হবে।
অরুণ যে দ্বারপথে ঘর হতে নিষ্ক্রান্ত হয়ে গেল তার ঠিক বিপরীত দ্বারপথে কাবেরীকে কোলে নিয়ে করুণার স্বামী মিঃ সঞ্জীব চৌধুরী এসে কক্ষে প্রবেশ করলেন।
একটু বেশী বয়সেই সঞ্জীব সোসাইটির অন্যতম রত্ন তরুণী করুণাকে বিবাহ করেছিলেন। এবং করুণার অনুপাতে তার স্বামী সঞ্জীবকে বৃদ্ধ বলেই মনে হয়। অতিরিক্ত খাটুনি ও পরিশ্রমে শরীর ভেঙ্গে গিয়েছে, মুখটা লম্বাটে হয়ে গিয়েছে। রগের দুপাশে চুলে পাক ধরেছে।
সঞ্জীব আসাম অঞ্চলের কোন এক চা-বাগানের ম্যানেজার। বেশ মোটা মাইনেই যে কেবল পান তা নয়, পিতৃসম্পত্তি এই বাড়িখানা ছাড়াও আরো খান-দুই বাড়ি কলকাতা শহরে ছিল। কিন্তু আজ আর একখানা বাড়িও তাঁর নিজস্ব বলতে নেই। যে বাড়িখানায় তাঁর স্ত্রী করুণা বর্তমানে আছে সেটাও দেনার দায়ে বিক্রি হয়ে গিয়েছে, এখন ক্রেতার কাছ হতেই মাসিক দুশ টাকা ভাড়া দিয়ে ওরা আছে।
করুণা ও সঞ্জীবের পরিচয় হয় কোন এক পার্টিতে।
সঞ্জীব চমৎকার আবৃত্তি করতে পারতেন ও বেহালা বাজানোর হাত ছিল তার সত্যিই মিষ্টি। কিন্তু অত্যন্ত চপল, বিলাসী ও অন্তঃসারশূন্য প্রকৃতির মেয়ে করুণা সঞ্জীবের গুণে নয়, তার মোটা মাইনের চাকরি, ব্যাঙ্ক-ব্যালান্স ও কলকাতা শহরের উপরে তিনখানা বাড়ির লোভেই এবং একান্ত বুদ্ধিমতী, বিধবা, স্কুল-মিসট্রেস মায়ের সৎপরামর্শেই এ বিবাহে অগ্রসর হয়েছিল। সঞ্জীবের বয়স তখন চুয়াল্লিশ পার হয়ে গেছে, করুণা পঞ্চবিংশতিবর্ষীয়া মাত্র।