ত্রিলোকের হৃদিরক্তে আঁকা তব চরণ শোণিমা,
স্বর্গ, মর্ত্য, আরাধ্যা, তুমি হে চিরবরেণ্যা।
কৃষ্ণা একটা সোফার উপরে বসে কাঁটা দিয়ে উলের একটা স্কার্ফ বুনছে। কাবেরী হাতে ঐদিনকার ইংরাজী একটা সংবাদপত্র নিয়ে কক্ষে এসে প্রবেশ করল, দিদি!
উঁ।
আজ কদিন থেকে খবরের কাগজে যে বিজ্ঞাপনটা বেরুচ্ছে—একজন সাইকোঅ্যানালিস্ট যমজ ভাই ও বোনদের study করে তাদের মানসিক ও চরিত্রগত প্রবৃত্তি থেকে তাদের এক হতে অন্যকে পৃথক করে নেওয়া যায় কিনা সে সম্পর্কে–
পড়েছি।
আয় না কেন, আমরা দুজনে দরখাস্ত করে দিই!
কৃষ্ণা কাবেরীর দিকে মুখ তুলে তাকাল, কুঞ্চিত ভ্রূযুগল।
বিনা পরিশ্রমে কেবল কথাবার্তা বলবার জন্য প্রত্যেক সিটিংয়ে টাকা দেবে–
না।
না কেন? এত সহজে অর্থোপার্জন! তাছাড়া টাকার তো আমাদের যথেষ্টই প্রয়োজন। এক্ষেত্রে–
তুই কি ক্ষেপে গেলি কাবি?
বাঃ রে! এতে ক্ষেপে যাবার মত কি দেখলি তুই?
তাছাড়া কি! সামান্য কয়েকটা টাকার জন্য ভদ্রঘরের মেয়ে হয়ে আমরা একজন পরপুরুষের সামনে বসে বসে তার খুশিমত যত সব আবোল-তাবোল প্রশ্নের জবাব দিয়ে যাবো! মান-সম্রম নেই আমাদের–
But really this is too much দিদি। তাছাড়া ভদ্র শিক্ষিত বিলাতফেরত ডাক্তার, তার রুচি ও ব্যবহার সম্পর্কে নিশ্চয়ই আমরা নিশ্চিন্ত থাকতে পারি।
বাবা! বাবার কথা ভুলে যাস না কাবি। হ্যাঁ, তুই তো জানিস কোন পুরুষের সংস্পর্শে আমরা আসি—এ তিনি একেবারে চান না। একটু থেমে আবার কৃষ্ণা বলে, তা ছাড়া বাবা মনে যাতে দুঃখ পান আমাদের তা করারই বা কি প্রয়োজন? কোন এক পরপুরুষ ডাক্তারের চেম্বারে একা একা তার সঙ্গে বসে বসে এভাবে sitting দেওয়ায় তিনি কিছুতেই মত দেবেন না।
নেপথ্য হতে ঠিক এমনি সময় ওদের পিতা সঞ্জীবের কণ্ঠস্বর ভেসে এলো, কৃষ্ণা কাবেরী!
কৃষ্ণা? যাই বাবা। চল, বাবা ডাকছেন।
দুই বোন ভিতরের ঘরের দিকে গেল।
.
ভিতরের একটি কক্ষ।
আসবাবপত্রের কোন বাহুল্যই নেই। একটি সিংগল খাট একপাশে, উপরে তার শুভ্র শয্যা বিছানো। একপাশে নানাজাতীয় ইংরাজী বাংলা বইতে ঠাসা একটা আলমারী। ছোট একটি বেতের টেবিলের উপরে মদের গেলাস ও মদের বোতল। একটি হেলান দেওয়া বেতের চেয়ারের ওপরে বসে, কোলে একটি মোটা বই, পাঠনিরত সঞ্জীব চৌধুরী।
অদূরে দেওয়ালের গায়ে দাঁড় করানো আছে একজোড়া ক্রাচ ও দেওয়ালে টাঙ্গানো একটি বেহালার বাক্স।
ক্রাচের সাহায্যেই সঞ্জীব চৌধুরী ঘরের মধ্যে সামান্য প্রয়োজনমত হাঁটা-চলা করেন।
সঞ্জীবের বয়স পঞ্চাশের ঊর্ধ্বে। সরু ছুঁচালো মুখ—মাথার চুল ঝাকড়া আঁকড়া। বহুকাল চিরুনির সংস্পর্শ নেই বলেই মনে হবে। কোটরপ্রবিষ্ট দুটি চক্ষু। দৃষ্টি তীক্ষ্ণ, অন্তর্ভেদী। দাড়িগোঁফ নিখুঁতভাবে কামানো। পরিধানে পায়জামা ও গায়ে কিমোনো।
কৃষ্ণা ও কাবেরী এসে কক্ষে প্রবেশ করল।
বই হতে চোখ না তুলেই সঞ্জীব মৃদু কণ্ঠে বলেন, তোমাদের বোনদের কথা কিছু কিছু আমার কানে এসেছে। I agree with কাবেরী
পিতার প্রকৃতিবিরুদ্ধ কথা শুনে দু বোনই যুগপৎ চমকে যেন পিতার মুখের দিকে তাকায়। কারো সঙ্গে মেলামেশা করা, বিশেষ করে কোন পরপুরুষের সঙ্গে, সঞ্জীব একেবারেই পছন্দ করেন না। তীক্ষ্ণ দৃষ্টি তাঁর সর্বদাই সজাগ ওদের প্রতি।
এমন কি এ কথাও তিনি বহুবার মেয়েদের বলেছেন, মেয়েদের স্বাধীনতার তিনি আদপেই পক্ষপাতী নন। মেয়েদের স্থান ঘরে-অন্দরের সীমানায়, আর লজ্জা ও সংযমের মধ্যে। শিক্ষার তাদের প্রয়োজন আছে, কিন্তু সে শিক্ষা স্কুল কলেজের ডিগ্রী শিক্ষা নয়। বাড়িতে বসেই তারা অধ্যয়ন করবে, শিক্ষালাভ করবে আত্মোন্নতির জন্য। বাইরের জগতের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক যতটা কম হয় ততই ভাল ও মঙ্গল। সেই জন্যই ম্যাট্রিক পাসের পর ঘরে বসেই আই-এর পাঠ পড়তে পড়তে তাদের পড়া বন্ধ হয়ে যায়। মোট কথা অতিমাত্রায় রক্ষণশীল পিতার প্রকৃতির সঙ্গে তাদের বেশ ভালভাবেই পরিচয় আছে।
সেই পিতার মুখে আজ এ কি কথা!
বিস্ময়ে দুই বোনই চেয়ে থাকে পিতার মুখের দিকে।
আবার সঞ্জীব বলে ওঠেন, বুঝতে পারছি তোমরা কি ভাবছো। মত আমার আজও বদলায় নি। তবু এ ব্যাপারে আমার মত আছে দুটি কারণে–
একটু থেমে আবার সঞ্জীব বলতে শুরু করেন, হ্যাঁ, দুটি কারণে, ১নং আমাদের কিছু টাকার প্রয়োজন। এযাবৎকাল তোমাদের দুজনের মাইনে হতে যা আমি বাঁচিয়েছি, তার উপরে আরো কিছু টাকা হলে আমরা কলকাতা ছেড়ে কোন গ্রামে গিয়ে কিছু জমি-জায়গা করে সাধারণভাবে নিরুপদ্রবে ও শানিতে জীবন কাটাতে পারবো। তোমরতা দু বোন প্রত্যেক sittingয়ের জন্য ১০০ টাকা করে চার্জ করবে, যদি এতে তারা রাজী হয় ভালো নচেৎ sitting দেবে না। আর ২নং কারণ—আমি দেখতে চাই এতদিন ধরে যে শিক্ষা তোমরা আমার কাছ হতে পেয়েছে, কতটুকু তার তোমরা গ্রহণ করেছে। সত্যিকারের মনের জোর যদি তোমাদের থাকে, তোমরা যে কোন situationয়েই উত্তীর্ণ হয়ে আসতে পারবে।
কাবেরী বেশী উৎসাহিত হয়ে ওঠে পিতার কথায়, বলে, তাহলে একটা দরখাস্ত করে দিই বাবা?
দাও—তবে হ্যাঁ, ঐ একশ টাকা করে তোমরা প্রত্যেক sittingয়ের জন্য চাও, এ কথাটা mention করতে ভুল হয় না যেন। •