না।
তার নাম হয় কৃষ্ণা না হয় কাবেরী!
হবে।
অতঃপর কিরীটী কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে, আচ্ছা আপনি যেতে পারেন।
বিনতা যেমন নিঃশব্দে ধীরে এসেছিলেন তেমনি নিঃশব্দেই চলে গেলেন।
কিরীটী রহমান সাহেবের দিকে তাকিয়ে বলল, এবারে চলুন ওঠা যাক রহমান সাহেব।
চলুন।
এরপর কিরীটী ও রহমান সুবিমল রানার কাছ হতে বিদায় নিয়ে চলে আসে।
সুবিমল নিজের ঘরে এসে একটা বই নিয়ে বসল। মনের মধ্যে অসংখ্য চিন্তা যেন জাল বুনে চলেছে একটা কালো মাকড়সার মত।
.
সন্ধ্যার অন্ধকার চারিদিকে নামছে ধূসর অঞ্চলখানি বিছিয়ে।
কিরীটী তার বসবার ঘরে একটা সোফার ওপরে অর্ধশায়িত অবস্থায় চক্ষু বুজে, একটা পা আর একটা পায়ের ওপর তুলে অভ্যাসমত মৃদু মৃদু নাচাচ্ছিল। নরেন মল্লিকের হত্যার রহস্যটা ঠিক যে কোথা হতে শুরু করা যেতে পারে, গতকাল ইস্পেক্টারের সঙ্গে অকুস্থান হতে ঘুরে আসা অবধি সেই চিন্তাটাই কিরীটীর মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছিল।
কতকগুলো বেখাপ্পা রকমের সূত্র বিশ্রী ভাবে জট পাকিয়েছে, সেগুলো সর্বাগ্রে ভোলার প্রয়োজন কিন্তু তারও আগে প্রয়োজন যমজ বোন কৃষ্ণা ও কাবেরীর মধ্যে আসল কোন্ জন মৃত নরেন মল্লিকের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ছিল সেইটাই জানা। ইপেক্টার মজিবুর রহমানের কথাই ঠিক, ওদের মধ্যে একজন স্পষ্টই মিথ্যা কথা বলছে।
কিন্তু কে বলছে মিথ্যা কথা?
এবং এও ঠিক, একজন মিথ্যা কথা বললেও দ্বিতীয়জন তাতে সায় দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু কেন?
আচ্ছা, এমনও তো হতে পারে দুজনেই মৃত নরেন মল্লিকের সঙ্গে বেশ ভালভাবেই পরিচিত ছিল। আচ্ছা পরিচিতাই যদি ছিল দুটি বোনই তবে ওদের মধ্যে একজনও সেদিন নরেন মল্লিকের জন্মতিথি উৎসবে, নরেন মল্লিকের বাড়িতে গেল না কেন?
চিন্তাস্রোত পাক খেয়ে ফিরতে থাকে।
আচ্ছা ঐ ধরনের যমজ বোন, তাদের একজনকে অন্যজন থেকে কি ভাবে পৃথক করা যেতে পারে? এবং সত্যিই সেটা সম্ভব কিনা?
এমন কোন লোক যে ছোটবেলা হতে ওদের চেনে না বা জানে না এবং ওদের ঠিক পরস্পরের পরস্পর হতে পার্থক্য কোথায় জানে না, সে যদি ওদের দুজনের মধ্যে একজনকে পৃথক করে নিতে চায়, কি ভাবে করতে পারে? এবং প্রকৃতপক্ষে সেটা আদপেই সম্ভবপর কিনা?
জংলী এসে অন্ধকার ঘরের মধ্যে প্রবেশ করল, বাবু?
কিরে জংলী?
রহমান সাহেব এসেছেন—আপনাকে—
নিয়ে আয়, এই উপরের ঘরেই নিয়ে আয়। যা।
একটু পরে রহমান সাহেব কক্ষে এসে প্রবেশ করলেন, এ কি! ঘর অন্ধকার কেন হে সত্যাশ্রয়ী?
কিরীটী তাড়াতাড়ি উঠে আলোটা জ্বেলে দেয়, আসুন, আসুন রহমান সাহেব। একটু পরেই আপনার কাছে যেতাম। আমার এক বন্ধু আছেন ডাঃ সুকুমার গুপ্ত, সাইকো অ্যানালিস্ট, চলুন তাঁর কাছে একবার যাবো, সে হয়ত কৃষ্ণা কাবেরীর ব্যাপারে আমাদের help করতে পারে–
.
থিয়েটার রোডে সুন্দর প্যাটার্নের একখানি দোতলা বাংলো বাড়ি। গেটের মাথায় নিওন সাইনে লেখা : Dr. Guptas Clinic; গেটের গায়ে নেমপ্লেটে লেখা?
Dr. Sukumar Gupta, D. Sc, M. R. c. P. (Lond) Neurologist.
কিরীটীর গাড়িটা এসে নিঃশব্দে বাংলোবাড়ির গেটের মধ্যে ঢুকলো।
ডাঃ গুপ্তের কনসালটিং চেম্বার। ভিতরের কক্ষটি চমৎকারভাবে সাজানোগোছানো। একটি সেক্রেটারিয়েট টেবিলের সামনে ঘূর্ণায়মান একটি চেয়ারের উপরে বসে ডাঃ গুপ্ত।
বেশ লম্বা, বলিষ্ঠ চেহারা, গায়ের বর্ণ উজ্জ্বল শ্যাম। পরিধানে দামী গরম সুট, তার উপরে সাদা অ্যাপ্রন। চোখে রিমলেস্ চশমা। দাড়িগোঁফ নিখুঁতভাবে কামানো। চশমার কাচের অন্তরালে তীক্ষ্ণ একজোড়া চক্ষু। চোখে-মুখে তীক্ষ্ণ বুদ্ধির একটি পরিচয় অত্যন্ত সুস্পষ্ট।
এদিককার চেয়ারে একজন চ্যাঙ্গা, রোগা, বৃদ্ধ ভাঃ গুপ্তর সঙ্গে বসে কথা বলছেন। বৃদ্ধটির পরিধানে দামী শান্তিপুরী ধুতি, গায়ে সার্জের গলাবন্ধ গরম কোট, কাধে দামী শাল একখানা পাট করা সযতনে। একমুখ দাড়িগোঁফ।
বৃদ্ধ বলছিলেন, বুঝলেন ডাঃ গুপ্ত, লভ—আমার ছেলে ন্যাপলার মস্তিষ্কে একালের ঐ লভ ব্যাধি ঢুকেছে। বৌমাটি আমার সতীলক্ষ্মী। এগার বছর বয়সের সময় ঘরে নিয়ে আসি মা-জননীকে আমার। বুঝলেন কিনা-ন্যাপলা কুম্মাণ্ডের বয়স তখন বাইশ। হারামজাদা ছয়ছয়টি কন্যের পিতা, বড় নাতনীটির বয়সই এখন তেরো। তা হতভাগা বুঝলেন কিনা—
ডাঃ গুপ্ত : দেখুন মিঃ চ্যাটার্জী, direct patient-য়ের সঙ্গেই কথা বলা দরকার কারণ এও এক ধরনের যৌন মনোবিকার, sexual insanity!
বৃদ্ধ ও কি বললেন?
ডাঃ গুপ্ত : sexual insanity মানে যৌন বিকৃতি, অর্থাৎ যৌন সংক্রান্ত মস্তিষ্ক বিকৃতি, তা-
বৃদ্ধ ও তা বেশ। হতভাগা কুণ্ডটাকে নিয়ে কবে আসতে হবে বলুন?
বেয়ারা এসে একখানা কার্ড দিল ডাঃ গুপ্তর হাতে।
কার্ডের দিকে তাকিয়েই ডাঃ গুপ্তর মুখটা উজ্জ্বল হয়ে ওঠে, আসতে বল। আচ্ছা মিঃ চ্যাটার্জী-তাহলে ঐ কথাই রইলো, আপনার ছেলেকে সঙ্গে করে একদিন নিয়েই আসবেন, তারপর যা করবার–
বৃদ্ধ ও আপনার ফিস্টা—
ডাক্তার : সোল।
বৃদ্ধ দেখুন ডাক্তার সাহেব, টাকার জন্য আপনি ভাববেন না। বুঝলেন কিনা—আপনার ন্যায্য ফিস ছাড়াও হতভাগাটির যদি মতিগতি ফিরিয়ে দিতে পারেন, আপনাকে খুশী করে দেবো, বুঝলেন কিনা—
.
কিরীটী আর রহমান সাহেব চেম্বারের সুইংডোর ঠেলে কমধ্যে এসে প্রবেশ করল; সুকুমার মৃদু হেসে বৃদ্ধকে সম্বোধন করে বলে, হবে হবে, আপনি আপনার ছেলেকে একদিন নিয়ে আসুন তো! তারপর কিরীটীর দিকে তাকিয়ে আনন্দোৎফুল্ল কণ্ঠে আহ্বান জানায়, এসো এসো রহস্যভেদী, তারপর?