ঐ আরাম-চেয়ারটার ওপরে বসে একটা কি বই পড়ছিলেন যেন।
তোমার সঙ্গে আর কোন কথা হয়েছিল তোমার বাবুর সে রাত্রে?
হ্যাঁ, বলেছিলেন দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে যেতে।
আর একটা কথা মধু, সেদিন সকালে মেথর এসে বাথরুম পরিষ্কার করে যাবার পর তুমি দরজাটা বন্ধ করে দিয়েছিলে?
তা মনে আছে বৈকি।
আচ্ছা তুমি যেতে পার মধু।
মধু ঘর ছেড়ে প্রায় চলে যেতে উদ্যত হতেই হঠাৎ কিরীটী আবার তাকে ডাকে, মধু?
আজ্ঞে! ফিরে দাঁড়াল মধু যেতে যেতে।
আচ্ছা মধু, তোমার বাবুর সঙ্গে তো তুমি অনেক দিন যাবৎ ছিলে, একটা কথা বলতে পারো, সাধারণত তোমার বাবুর ঘুম কেমন ছিল, রাত্রে কখনো উঠতেন কিনা?
তা ঠিক বলতে পারি না বাবু—তবে একবার-আধবার উঠতেন বোধ হয় মাঝরাত্রে।
মধু, বলতে পারো তোমার বাবুর স্বভাবচরিত্র কেমন ছিল?
এবারে মধু মাথা নিচু করে।
বল, এতে লজ্জার কিছু নেই। শোন মধু, তোমার বাবুর হত্যার মীমাংসা করতে হলে তার সব কথাই যে আমাদের জানা দরকার—
আজ্ঞে—মেয়েছেলে ইদানীং, বিশেষ করে সেই সুন্দর দিদিমণি এখানে যাতায়াত করতেন। বটে, তবে কখনো কোন খারাপ কিছু বা নষ্টামি আমার চোখে পড়েনি।
আচ্ছা যাও।
এরপর এলো সুবিমল, নিহত নরেন মল্লিকের ভাগ্নে।
আপনার নাম সুবিমল রানা?
হাঁ।
বসুন, বসুন-দাঁড়িয়ে রইলেন কেন? আমাদের কর্তব্যটাই বড় বিশ্রী।
সুবিমল নির্দিষ্ট চেয়ারটার উপরে উপবেশন করে।
তারপর হঠাৎ ইন্সপেক্টারের দিকে চেয়ে সুবিমল বলে, ইপেক্টার, সেদিন আপনি মামার উইল সম্পর্কে আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, আমি কিছুই বলতে পারিনি তখন, কারণ সে সম্পর্কে তখনও আমি কিছুই জানতাম না। কাল সন্ধ্যার দিকে মামার সলিসিটার বোস এণ্ড চৌধুরীর মিঃ রাধেশ চৌধুরী এসেছিলেন। মামা উইল কিছুই যদিও লিখিতভাবে করে যাননি-তবে he had definite instructions–
বটে! কি instructions ছিল? রহমান প্রশ্ন করেন।
আমিই তার অবর্তমানে সমস্ত সম্পত্তির মালিক হব।
হুঁ, Good news no doubt! রহমান সানন্দে বলেন।
হঠাৎ কিরীটী প্রশ্ন করে, মিঃ মল্লিকের সলিসিটারের কাছে তার সম্পত্তির পরিমাণ সম্পর্কে কোন কিছু শোনেননি সুবিমলবাবু? মানে কোন definite idea?
চোখ তুলে তাকাল সুবিমল কিরীটীর দিকে, তারপর মৃদু কণ্ঠে বললে, হাঁ বলেছেন। ব্যাংকে তার নগদ হাজার পঞ্চাশেক টাকা, কলকাতায় পার্ক সার্কাসের এই বাড়ি, যার valuation প্রায় সত্তর হাজার টাকা দাঁড়িয়েছে, তাছাড়া কিছু কোম্পানীর কাগজ।
A good fortune! স্মিতভাবে কিরীটী বলে।
Really lucky আপনি মিঃ রানা। রহমান বলেন।
কিন্তু একা মানুষ আমি, এক বুড়ী বিধবা মা মাত্র সংসারে, কি হবে আমার এই বিরাট সম্পত্তি দিয়ে ইন্সপেক্টার! এর চাইতে তিনি—মামা যদি বেঁচে থাকতেন—বলতে বলতে সহসা সুবিমলের চোখের কোণ দুটো অশ্রুতে ঝাপসা হয়ে যায়। ট ট করে কয়েক ফোঁটা অশ্রুও গাল বেয়ে ঝরে পড়ে।
আর একটা কথা সুবিমলবাবু! কিরীটী আবার প্রশ্ন করে।
বলুন?
আপনি বলেছেন, সে রাত্রে আপনি প্রায় সোয়া একটার সময় বাড়ি ফিরেছিলেন, রানাঘাট কোথায় যেন গিয়েছিলেন–
হ্যাঁ, রানাঘাটেই insuranceয়ের একটা জরুরী কাজে যেতে হয়েছিল।
কোন্ ট্রেনে রানাঘাট হতে ফেরেন?
শেষ ট্রেনে, রাত সাড়ে এগারটায়।
সাড়ে এগারটায়?
হ্যাঁ, ট্রেনটা একটু লেট ছিল।
ওঃ, সাড়ে এগারটায় শিয়ালদহে পৌঁছালেন তো বাড়িতে পৌঁছাতে এত দেরি হলো যে?
ট্রাম, বাস বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, একটা ট্যাক্সিও ছিল না। কোনমতে একটা রিক্সা করে এসেছিলাম।
.
এরপর ডাক পড়ল বিনতা দেবীর। সুবিমল ঘর থেকে চলে যাবার মিনিট দশেক বাদেই এলেন বিনতা দেবী। দীর্ঘ অবগুণ্ঠন টানা, সাদা থান পরিহিতা, নিরাভরণা, ধীর সংযত চলুন।
কিরীটীই কথা বলে, বসুন বিনতা দেবী।
বিনতা দেবী বসলেনও না, কোন সাড়াও দিলেন না। যেমন দাঁড়িয়ে ছিলেন তেমনিই দাঁড়িয়ে রইলেন।
।কিরীটী লক্ষ্য করছিল বিনতা দেবী শুধু যে মুখখানাই তার অবগুণ্ঠনের আড়ালে সযতনে রেখেছিলেন তাই নয়, সর্ব অবয়বই যেন পরিধেয় বস্ত্র দ্বারা অন্যের দৃষ্টির সামনে থেকে আড়াল করবার একটা সুস্পষ্ট সযত্ন প্রয়াস প্রকাশ পাচ্ছিল।
কয়েকটা কথা জিজ্ঞাসা করবার জন্য আপনাকে ডেকেছি বিনতা দেবী। কিরীটী বলে।
এবারও কোন জবাব পাওয়া গেল না।
আপনার বাড়ি কোথায়?
বর্ধমানে। মৃদুকণ্ঠে জবাব এল।
আপনার আত্মীয়স্বজন কেউ আছেন?
না।
কেউ নেই?
না।
আপনার স্বামী কতদিন আগে মারা গেছেন?
দশ-বারো বছরের বেশি হবে।
সুবিমলবাবু যদি আপনাকে চাকরিতে রাখেন তাহলে তো আপনি এখানেই থাকবেন?
না। আমি আর চাকরি করবো না, সুবিমলবাবুকে পরশুই বলে দিয়েছি।
চাকরি আর করবেন না?
না।
দেশে ফিরে যাবেন বুঝি?
বলতে পারি না।
আচ্ছা নরেন মল্লিকের সঙ্গে কি এখানে আপনার চাকরির এই কয় মাসে কখনো কথা বলেননি?
না।
নরেনবাবু লোক কেমন ছিলেন আপনার ধারণা?
ভালই।
কৃষ্ণা কাবেরীকে আপনি চেনেন?
বিনতা চুপ করে থাকেন শেষের প্রশ্নে।
কই, আমার প্রশ্নের জবাব দিলেন না?
কি জবাব দেবো?
কৃষ্ণা কাবেরীকে আপনি চেনেন?
না।
ঐ নাম দুটি কখনো শোনেননি?
না।
নরেনবাবুর সঙ্গে যে একটি সুন্দরী তরুণীর আলাপ ছিল, মধ্যে মধ্যে যিনি এ বাড়িতে আসতেন, তাকে কখনো দেখেন নি?
দেখেছি।
তার নাম শোনেন নি কখনও?