বিস্মিত রহমান কিরীটীর মুখের দিকে তাকান, ব্যাপারটা তিনি যেন ঠিক বুঝে উঠতে পারছেন না। বুঝে উঠতে পারছেন না যেন কিরীটী ঠিক কি বলতে চায়!
কি কি পয়েন্টস্ বলুন তো মিঃ রায়? তবু প্রশ্ন করেন।
প্রথমতঃ ধরুন, আপনার ঐ যমজ বোন কৃষ্ণা ও কাবেরী, circumstantial evidence থেকে মনে হয়, ওদের মধ্যে একজন বা দুজনই মৃত নরেন মল্লিকের সঙ্গে বিশেষ এবং ঘনিষ্ঠ ভাবেই পরিচিত ছিল; অথচ মিঃ মল্লিকের জন্মতিথি বা জন্মদিন উৎসবে ওদের মধ্যে কেউই কেন নিমন্ত্রিতা হলো না কেন? এবং ওরা দুই বোনই যে অস্বীকার করেছে তাদের নিজ নিজ জবানবন্দীতে যে, ওদের কেউই কখনো নরেন মল্লিকের গৃহে আসেনি সেও মিথ্যা। কারণ। মল্লিক-বাড়ির অন্যান্য দু-একজনের জবানবন্দী থেকেই সেটা প্রমাণিত হয়, কিন্তু এখন কথা হচ্ছে কৃষ্ণা কাবেরী মিথ্যা কথা বললে কেন? মিথ্যা তারা বলেছে নিঃসন্দেহে এবং তারা যে বুদ্ধিমতী যথেষ্ট সে বিষয়েও সন্দেহের কোন অবকাশ মাত্র নেই। তারপর দ্বিতীয়তঃ, যে রাত্রে নরেন মল্লিক নিহত হন, সে রাত্রে এগারোটার পরে দারোয়ান দেখেছে তার ঘরের আলো নিবে গিয়েছে, অথচ সুবিমলের জবানবন্দী থেকে আমরা জানতে পারছি যে, রাত্রি এগারটার পরে মিঃ মল্লিকের ঘরে আলো জ্বলছিল। এর দ্বারা এই প্রমাণ হয়, রাত্রি এগারোটায় আলো নিবে গেলেও যে কোন কারণেই হোক, রাত্রি একটায় আবার ঘরের আলো জ্বলেছিল সুনিশ্চিত, কিন্তু কেন? তৃতীয়তঃ মিঃ মল্লিকের শয়নকক্ষের সংলগ্ন বাথরুমে মেথর যাতায়াতের দরজাটা পরের দিন সকালে ছিল ভিতর হতে বন্ধ-কেন? চতুর্থতঃ এবং বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট হচ্ছে, ঘরের ঐ আয়নার কঁচটা ভাঙ্গল অথচ সেরাত্রে এ বাড়ির কেউ কোন শব্দ পেল না, কেন? পঞ্চম, আয়নার কঁচটা ভাঙ্গল অথচ মিঃ মল্লিক খুন হয়েছেন ছোরার আঘাতে—কেন? ষষ্ঠ : নরেন মল্লিক যে ছোরাটার দ্বারা নিহত হয়েছেন সে ছোরাটা তারই ঘরে ছিল এবং খুনী অন্য কোন ছোরা ব্যবহার না করে, বিশেষ করে ঐ ছোরাটাই বা ব্যবহার করতে গেল কেন?
মিঃ রহমান ভাবেন লোকটা পাগল নাকি, খুনের তদন্ত করতে এসে এসব কি অদ্ভুত আবোল-তাবোল প্রশ্ন নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছেন!
মধ্যে যাতায়াতের জন্য যাতায়াতের দরজাটা বন্ধ ছিল কেন, ঘরের আলো দুবার জ্বলেছে কেন, ঘরের আয়নাটার কাচ ভাঙ্গল কেন, শব্দ কেউ শুনতে পেল না কেন?
মনে মনে রহমান সাহেব একটু বিরক্তই হন। কিন্তু মুখে কিছু বলতে পারেন না।
আমার কি মনে হয় জানেন মিঃ রহমান—কিরীটী আবার বলে।
কি?
ঐ আয়নার কঁচটা ভাঙ্গার ব্যাপার ও শব্দটা যে কারো না কারো অন্ততঃ এ বাড়িতে শুনতে পাওয়া উচিত ছিল অথচ শোনা যায়নি—এ দুয়ের মধ্যে একটা ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ আছে।
যে শব্দটা কারো না কারো অন্ততঃ শুনতে পাওয়া উচিত ছিল অথচ শোনা যায়নি!
হাঁ। যে শব্দটা হারিয়ে গিয়েছে মিস্টিরিয়ালি অথচ যার অতীত অস্তিত্ব সম্পর্কে মনে আমার বিন্দুমাত্রও দ্বিধা বা সন্দেহ নেই। তারপর ধরুন আপনার ওই যমজ বোন কৃষ্ণা ও কাবেরী, তা যাক গে সেকথা, পরেও ভাবা চলতে পারে তাদের কথা, আপাতত আপনার মধু ও সুবিমলবাবু যদি বাড়িতে থেকে থাকেন তাদের এবং বিনতা দেবী ও দারোয়ান রামখেল সিং এই চারজনকে গোটাকতক কথা আমি জিজ্ঞাসা করতে চাই।
খোঁজ নিয়ে জানা গেল চারজনই তখন বাড়িতেই আছে।
প্রথমে ডাকা হলো দারোয়ানকে।
তোমারই নাম রামখেল? কিরীটীই প্রশ্ন করে।
জি।
আচ্ছা যে রাত্রে তোমার বাবু মারা যান সে রাত্রে তুমি দেখেছিলে সাড়ে এগারটায় বাবুর শোবার ঘরের আলো নিবে যায়, তাই না?
জি।
কেমন করে জানলে যে ঠিক তখন রাত সাড়ে এগারটা?
হরি ফিরে এলে আমাদের ঘরে একটা ঘড়ি আছে সেটায় ঢং ঢং করে এগারটা বাজল। তারপর আবার ঠিক ঢং করে সাড়ে এগারটার ঘণ্টা বাজতেই আমি শুতে যাবো বলে গেটের তালাটা আর একবার দেখতে যাই, ঠিক সেই সময় দেখলাম বাবুর ঘরের আলোটা নিবে গেল।
তারপর সুবিমলবাবু যখন ফিরে আসেন রাত্রে তুমি গেট খুলে দাও, কেমন তো?
হাঁ।
তখন বাবুর ঘরের আলো জ্বলছিল কিনা লক্ষ্য করেছিলে?
জি না। ঘুম-চোখে এসে গেট খুলেছি অতটা লক্ষ্য করিনি।
রাত্রি সাড়ে বারোটার মধ্যে কোন শব্দ শুনেছিলে? যেমন ধর কোন কঁচটাচ ভাঙ্গার শব্দ?
না। ঘুমিয়েছিলাম।
সুবিমলবাবু ডাকতেই তোমার ঘুম ভেঙ্গে যায়, তাই না?
জি না, আমার ঘরে কলিং বেল আছে, সেই বেলের শব্দে ঘুম ভেঙ্গেছিল।
আচ্ছা তুমি যেতে পারো।
রামখেল অতঃপর চলে গেল।
এরপর এলো মধু।
কিরীটী এবার তাকে প্রশ্ন শুরু করে।
আচ্ছা মধু, তোমার বাবুর শোবার ঘরের দরজাটা সাধারণত রাত্রে খুলেই কি বাবু ঘুমোতেন?
হ্যাঁ। রাত্রে তিনি কখনো দরজা বন্ধ করতেন না। রোজ সকালে আমিই এসে তার ঘুম ভাঙ্গিয়ে গরম নুন-জল দিতাম কিনা, তাই দরজা খোলাই থাকত।
আচ্ছা সে রাত্রে তুমি যখন গরম দুধ নিয়ে এলে, বাবু তখনি দুধটা খেয়েছিলেন কি?
হ্যাঁ, দুধটা খাবার পর আমি যখন খালি গ্লাসটা নিয়ে যাচ্ছি, তিনি আমাকে এক গ্লাস ঠাণ্ডা জল ঘরে রেখে যেতে বললেন। শোবার আগে বাবু এক গ্লাস ঠাণ্ডা জল খেতেন।
তাহলে গ্লাস হাতে তুমি যখন ঘর হতে বের হয়ে যাও বাবু তখনও শোন নি, তাই না?
হ্যাঁ।
কি করছিলেন তখন তিনি মনে আছে তোমার?