কৃষ্ণা তখন বলতে শুরু করে, গত রবিবার-শরীর আমার বিশেষ রকম ক্লান্ত থাকায় সারাটা দিন ঘরেই বই পড়ে ও ঘুমিয়ে কাটিয়েছি। তারপর রাত্রি দশটায় খেয়েদেয়ে একেবারে শুয়ে পড়ি।
আপনি কাবেরী দেবী?
সারাটা দিন আমিও বাড়িতেই ছিলাম। রাত্রি সাড়ে সাতটায় একটু গঙ্গার ধারে বেড়াতে যাই।
কতক্ষণ পর্যন্ত সেখানে ছিলেন?
রাত্রি দশটা পর্যন্ত।
কি করে বুঝলেন ঠিক সময়টা?
হাতে ঘড়ি ছিল, ফিরবার মুখে দেখেছি রাত তখন দশটা ঠিক।
বাড়িতে ফিরে আসেন কখন?
এই সাড়ে দশটা নাগাদ হবে।
এসে দেখলেন আপনার দিদি তখন ঘুমিয়ে বোধ হয়?
হ্যাঁ।
আচ্ছা গঙ্গার ধারে যতক্ষণ ছিলেন, কারো সঙ্গে আপনার দেখা হয়নি?
হয়েছিল—দুজনের সঙ্গে।
তাদের নাম পরিচয়টা জানতে পারি কি?
একজনের পরিচয় দিতে পারবো না—অবশ্য আপনি আমার কথা বিশ্বাস করতে পারেন, তিনি আপনার নরেন মল্লিক নন—
হুঁ। আর দ্বিতীয় জন?
আমার এক পরিচিত অ্যাডভোকেট বন্ধু–রবীন সেন, তিনিও ঐ সময় গাড়িতে গঙ্গার ধারে বেড়াতে এসেছিলেন।
আপনাদের কোন previous engagement ছিল ঐ সময় meet করবার?
না। বলতে পারেন নেহাৎ আকস্মিক ভাবেই তার সঙ্গে সেখানে দেখা হয়েছিল আমার।
তার ঠিকানাটা?
৩।১ রিজেন্ট পার্ক–টালিগঞ্জ।
মিঃ সেন ওখানে কখন পৌঁছেছিলেন?
রাত্রি সাড়ে আটটা বোধ হয়।
একসঙ্গেই বোধ হয় আপনারা ফিরে আসেন?
হ্যাঁ। তিনিই তার গাড়িতে করে আমাকে পার্ক সার্কাস মার্কেট পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে যান।
এরপর খোদাবক্স বিনীত ভাবে উভয়কেই সম্বোধন করে বলেন, আবার হয়ত দেখা হতে পারে। আচ্ছা আজ আসি, নমস্কার।
কৃষ্ণা কিন্তু চুপ করেই থাকে। চোখেমুখে বিরক্তির চিহ্নটা তখনও কৃষ্ণার নিঃশেষে মুছে যায়নি যেন।
.
গাড়ি চলেছে নরেন মল্লিকের গৃহের দিকে। ফাইলটা রহমানের হাতে ফিরিয়ে দিতে দিতে কিরীটী বলে, দুটি যমজ বোন সম্পর্কে আপনার মতামতটা কি রহমান সাহেব?
One of them must be telling deliberate lies—
আমারও তাই মনে হয়, রহমান সাহেব।
শুধু তাই নয়—আমার স্থির ধারণা মিঃ রায়, যমজ ওই দুই বোনের মধ্যেই একজন খুনী।
হতে পারে আবার নাও হতে পারে।
গাড়ি ইতিমধ্যে নরেন মল্লিকের বাড়ির সামনে এসে গিয়েছিল।
We have reached our destination মিঃ রায়।
গাড়ি গেটের মধ্যে প্রবেশ করল। গাড়ি হতে নামতে নামতে, কিরীটী তার অর্ধসমাপ্ত কথার জের টেনে বলে, একটা কথা কি জানেন রহমান সাহেব, স্রেফ probabilityর উপরেই basis করে এসব ক্ষেত্রে সবসময় conclusionয়ে পৌঁছানো যায় না, আর investigationয়ের ব্যাপারে সে proceedure-ও ভুল। হত্যা-রহস্যের মীমাংসার ব্যাপারে আরও ব্যাপক ও সূক্ষ্ম তদন্তের প্রয়োজন।
নরেন মল্লিক যে ঘরে নিহত হয়েছিল সে ঘরে তেমনি তালা দেওয়াই ছিল। রহমান সাহেব পকেট হতে চাবি বের করে তালাটা খুলে ফেললেন, দরজাটা নিঃশব্দে খুলে গেল।
ঘরটা অন্ধকার দিনের বেলাতেও। কারণ জানালা-দরজাগুলো সব বন্ধই ছিল। রহমান একে একে ঘরের জানালা-দরজাগুলো খুলে দিলেন। সকালের আলোয় ঘরটা ঝলমল করে ওঠে। ঘরের মেঝেতে সুদৃশ্য গালিচা বিস্তৃত, একটি সুদৃশ্য পালঙ্কে ধবধবে শয্যা বিছানো।
একটি আলমারি, গোটা দুই কাউছ, একটি রকিং আর্ম-চেয়ার। দেওয়ালে সুদৃশ্য সব পেনটিং। হঠাৎ কিরীটীর অনুসন্ধানী দৃষ্টি দেওয়ালে টাঙ্গানো একটি প্রমাণ আয়নার উপরে গিয়ে স্থিরনিবদ্ধ হলো।
আয়নার কঁচটা ভাঙ্গা, মনে হয় কোন ভারী বস্তুর আঘাতে ভেঙ্গে গিয়েছে চৌচির হয়ে যেন।
আশ্চর্য! অস্ফুট কণ্ঠে কতকটা স্বগতোক্তির মতই কথাটা উচ্চারণ করে কিরীটী।
কি? রহমান কিরীটীর কণ্ঠস্বরে ফিরে তাকালেন।
ওই বড় আয়নাটা-ওটা কি সেদিন ভাঙ্গাই দেখেছিলেন?
লক্ষ্য করিনি, কিন্তু কেন বলুন তো?
এই ঘরের অন্যান্য জিনিসপত্র সব লক্ষ্য করে দেখলেই বুঝবেন, এ ঘরে যে ব্যক্তি থাকতেন, তাঁর রুচিতে ঘরের মধ্যে এমন একটি ভাঙ্গা আয়না ঝুলিয়ে রাখা উঁহু, সম্ভব নয়।
কিন্তু—
ডাকুন আপনার সেই মধু চাকরকে, সে-ই হয়ত প্রমাণ দিতে পারবে।
তক্ষুনি মধুকে ডাকা হলো এবং সবিস্ময়ে সে বললে, আয়নাটা আগে ভাঙ্গা ছিল না।
মধু চলে গেলে কিরীটী আবার ঘরের ভিতরটা ভাল করে চারিদিকে দৃষ্টি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখতে লাগল।
আয়নাটা ঘরের মধ্যে এমনি ভাবে ঝুলানো, যাতে করে শয়নকক্ষ-সংলগ্ন স্নানঘর থেকে বের হলে প্রথমেই আয়নার উপরে ছায়া পড়ে। বাথরুমটা পরীক্ষা করে দেখা গেল, বাথরুমের বাইরে দিয়ে মেথর যাতায়াতের জন্য একটি ঘোরানো লোহার সিঁড়িও আছে। তবে বাথরুমের দরজাটি তখন বন্ধই ছিল।
রহমান সাহেবও বললেন, সেদিনও মানে তদন্তের দিনও নাকি দরজাটি বন্ধই ছিল তিনি দেখেছিলেন। এবং সেদিন খোঁজ নিয়ে জানা গিয়েছিল, দিনে একবার মাত্র দরজাটি নাকি খোলা হত এবং মেথরের কাজ শেষ হলেই আবার বন্ধ করে রাখা হত।
রবিবার মধুই মেথর কাজ সেরে চলে যাবার পর নিজহাতে দরজাটা বন্ধ করে দিয়েছিল।
কিরীটী একটা সিগারে অগ্নিসংযোগ করে ধূমোদ্গীরণ করতে করতে বলে, ভাঙ্গা আয়না অথচ কেউ সে-রাত্রে কোনরকম শব্দই শোনেনি!
কি বলছেন মিঃ রায়? মজিবুর রহমান প্রশ্ন করেন।
কিরীটী মজিবুরের প্রশ্নটা আপাতত এড়িয়ে গিয়ে প্রসঙ্গান্তরে চলে গিয়ে বলে, আচ্ছা মিঃ রহমান, এই নরেন মল্লিকের হত্যার ব্যাপারে আপাতত ছটা পয়েন্ট অত্যন্ত এলোমেলো বা জট পাকানো বলে কি মনে হচ্ছে না আপনার?