কি–কি ওটা মিত্রানীর গলায়! কাজল চেঁচিয়ে উঠল চাপা কণ্ঠে। তবে—তবে কি ওকে কেউ গলায় রুমালের ফাঁস দিয়ে শ্বাসরুদ্ধ করে—
অমিয় তখনো তাকিয়ে ছিল, মিত্রানীর গলার দিকে। সে-ই বললে, হা-ওকে রুমালের ফাঁস দিয়ে শ্বাসরোধ করেই মেরেছে–
চিৎকার করে ওঠে কাজল, খুন!
অমিয় আবার বললে, হ্যাঁ—আমার তো তাই মনে হচ্ছে কাজল। সাম ওয়ান কিল্ড হার। শি হ্যাজ বীন ব্রুটালি মাড়ার্ড।
সুহাস বললে, কিন্তু কে? কে হত্যা করলে মিত্রানীকে ঐভাবে—
ক্ষিতীশ বললে, কে হত্যা করেছে এখনো জানি না বটে, তবে ওকে যে হত্যা করা হয়েছে—তাতে কোন ভুল নেই—
মিত্রানীকে হত্যা করা হয়েছে!
কথাটা যেন প্রচণ্ড একটা শব্দ তুলে সকলের কর্ণপটাহের উপর আছড়ে পড়লো একই সঙ্গে।
তাহলে এখন কি করবো? ক্ষিতীশের প্রশ্ন। তার গলার স্বরটা যেন কেঁপে গেল। মনে হলো সে যেন বেশ নার্ভাস হয়ে পড়েছে।
সন্ধ্যায় অন্ধকার আরো ঘন—আরো গাঢ় হয়েছে।
অস্বাভাবিক একটা স্তব্ধতা যেন চারিদিকে।
আবার নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করলো সুহাসই। বললে, এভাবে এখানে দাঁড়িয়ে থাকলেই তো চলবে না। একটা কিছু তো আমাদের করতেই হবে মণি।
দলের মধ্যে মণিময়ই সব চাইতে বেশী প্র্যাকটিক্যাল। ভেবেচিন্তে কাজ করে এবং বরাবরই দলের সংকট-মুহূর্তে যা পরামর্শ দেবার সে-ই দেয়। এতক্ষণ সে একটি কথাও বলেনি—চুপচাপ এক পাশে দাঁড়িয়ে ছিল, সুহাসের প্রশ্নে এতক্ষণে সে কথা বললো, আমার মনে হয় সুহাস এক্ষেত্রে আমাদের একটি মাত্রই কর্তব্য
মিনমিনে গলায় জবাব দিল অমিয়, কি?
আমাদের মধ্যে যে হোক একজন এখুনি শিবপুর থানায় চলে গিয়ে ব্যাপারটা তাদের বলুক
থানায়—থানায় কেন? সুহাস কাপা গলায় প্রশ্ন করে অন্ধকারেই মণিময়ের মুখের দিকে তাকাল।
বুঝতে পারছে না সুহাস, মিত্রানীর মৃত্যুটা স্বাভাবিক নয় যখন, তখন থানায় খবর একটা আমাদের দিতেই হবে। ধীরে ধীরে কথাগুলো বললে মণিময়।
কিন্তু থানায় খবর দিলে—
সুহাসকে থামিয়ে দিয়ে মণিময় বললে, তাছাড়া আমরা আর কি করতে পারি সুহাস? মৃতদেহটা এখান থেকে নিয়ে গেলে বা ফেলে রেখে গেলে এখানেই, আমরা সকলেই বিপদের মধ্যে জড়িয়ে পড়বো—
বিপদ! বিপদে পড়বো কেন? সুহাস আবার বললো।
কি বলছো সুহাস! আমাদের সকলকে আজ এখানে সেই সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত কতজনায় হয়ত হৈ চৈ করতে দেখেছে—তাদের মধ্যে কেউ যদি আমাদের কারোর পাড়ার লোক হয়, আমাদের কাউকে চিনে থাকে—ব্যাপারটা জানাজানি হয়ে গেলে পুলিস যখন খোঁজখবর শুরু করবে সেই সময় যদি–
মণিময়কে থামিয়ে দিয়ে সতীন্দ্র এতক্ষণে কথা বললো, য়ু আর রাইট মণিময়, সঙ্গে করে নিয়ে গেলে ডেথ সার্টিফিকেট-এর হাঙ্গামা, তাছাড়া শুধু ডেথ সার্টিফিকেট হলেই হবে না—মিত্রানীর বাবা আছেন ডাক্তার দাদা আছেন, তাঁদেরই বা কি বলবো? আর তাদের অজ্ঞাতে ডেড বডি সকারই বা করবো কি করে—আর যদি এখানে ফেলে যাই, একটু আগে মণিময় যা বললো—আরো জটিলতার সৃষ্টি হবে। তার চাইতে আমিই না হয় যাচ্ছি থানায় সেখানে থেকে ডেকে নিয়ে আসি সব কথা বলে—তোমরা ততক্ষণ এখানে অপেক্ষা করো।
কথাগুলো বলে সতীন্দ্র অন্ধকারে মিলিয়ে গেল।
ওরা সাতজন অন্ধকারে ভূতের মত যেন দাঁড়িয়ে রইলো।
কেউ কারো মুখ ভাল করে দেখতে পাচ্ছে না। আবছা-ঝাপসা অথচ অন্ধকার থাকার কথা নয়—চাদনী রাত—কিন্তু একটা হালকা মেঘের তলায় চাদ ঢাকা পড়ায় চাঁদের আলো প্রকাশ পায়নি।
ক্ষিতীশ, বিদ্যুৎ, অমিয়, সুহাস, মণিময়, কাজল, পাপিয়া অল্প অল্প ব্যবধানে সব দাঁড়িয়ে।
অমিয় ওদের মধ্যে চেইন স্মােকার। এতক্ষণ সে একটিও সিগারেট ধরায়নি। ক্ষিতীশ ঘন ঘন নস্য নেয়—সেও যেন নস্য নিতে ভুলে গিয়েছে।
আরো কিছুক্ষণ পরে চারিদিকে চাঁদের আলো ছড়িয়ে পড়লো। অন্ধকার সরে গিয়ে সব যেন স্পষ্ট হয়ে উঠলো। সকলেই সকলকে এখন দেখতে পাচ্ছে। সকলেই দেখতে পাচ্ছে তাদের সামনে পড়ে আছে মিত্রানীর প্রাণহীন দেহটা।
ঘড়ির কাঁটা যেন আর ঘুরছেই না। থেমে গিয়েছে—সময় যেন হঠাৎ থমকে থেমে গিয়েছে। নিস্তব্ধতা যেন আরো কষ্টকর—আরো দুঃসহ।
অত বড় গার্ডেনটা একেবারে জনপ্ৰাণীহীন–একটা স্টীমারের ভো শোনা গেল। শব্দটা কাপতে কাপতে মিলিয়ে গেল।
আরো—আরো অনেক পরে। দূর থেকে একটা গাড়ির হেডলাইট দেখা গেল—ঐ দিকেই আসছে আলোটা। দুটো প্রোজ্জ্বল অনুসন্ধানী চোখের মত একেবারে এগিয়ে আসে আর সেই সঙ্গে শোনা যায় দূরাগত একটা গাড়ির ইজিনের শব্দ। শব্দটা স্পষ্ট হতে
স্পষ্টতর হয়।
একটা জীপ গাড়ি এসে থামল ওদের সামনে।
প্রথমে থানা-অফিসার সুশীল নন্দী—দুজন কনস্টেবল—আর নামলো সতীন্দ্র।
কোথায় ডেডবডি? সুশীল নন্দী জিজ্ঞাসা করলেন।
ঐ যে, সতীন্দ্র দেখিয়ে দিল।
হাতে নন্দীর জোরালো টর্চ ছিল, সেই আলো ফেলে নন্দী মিত্রানীর মৃতদেহের সামনে এগিয়ে এসে দাঁড়ালেন। নেড়েচেড়ে পরীক্ষা করলেন মৃতদেহটা—গলার ফাসটা দেখলেন, তারপর উঠে দাঁড়ালেন। সকলের মুখের দিকে তাকালেন।
সুশীল নন্দী আগেই থানায় বসে সতীন্দ্রর কাছ থেকে ব্যাপারটা শুনেছিলেন—তাই বোধ হয় ঘটনার পুনরাবৃত্তিতে আর গেলেন না। সোজাসুজিই একেবারে প্রশ্ন শুরু করলেন—আপনারা তা হলে কেউই কিছু জানেন না বা দেখেনও নি—কে ওর গলায় ফাঁস দিয়ে ওকে খুন করলো?
সবাই চুপ। কারো মুখে কোন কথা নেই।
হুঁ। আচ্ছা ভদ্রমহিলার কোন শত্রু বা ঐ ধরনের কিছু ছিল?