ডাকঘর কতদূর এখান থেকে? দুটোর সময় বের হয়ে সাড়ে পাঁচটায় ফিরলেন চিঠি পোস্ট করে!
বলতে পারি না, অন্য কোথাও হয়ত যেতে পারে।
একটা কথা মণিকা দেবী, ঠিক দুটোর সময়ই যে অতুলবাবুবাইরে গিয়েছিলেন ঠিক আপনার মনে আছে?
হ্যাঁ। তার কারণ অতুল চলে যাবার পরেই ইলেকট্রিক মিস্ত্রী অতুলের ঘরের আলোটা ঠিক করতে আসে বংশী এসে যখন মিস্ত্রী এসেছে বললে তার আগে আমার একটু তন্দ্রা মত এসেছিল। ঘর থেকে বেরুতে যাব এমন সময় ঘরের ওয়াল-কুকটায় ঢং ঢং করে দুটো বাজল। তাইতেই সময়টা আমার মনে আছে।
মণিকার মুখের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল কিরীটী। তার সমস্ত ইন্দ্রিয় যেন হঠাৎ অত্যন্ত সজাগ ও তীক্ষ্ণ হয়ে মণিকার কথা শুনছিল। চোখেমুখে একটা অদ্ভুত ব্যাকুল সুতীব্র উৎকণ্ঠা স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
গতকাল ইলেকট্রিক মিস্ত্রী এসেছিল এই ঘরের আলো ঠিক করতে?
হ্যাঁ।
কেন?
ঘরের আলোটা পরশু রাত্রে হঠাৎ খারাপ হয়ে যায়। গতকাল সকালে উঠেই অতুল বলেছিল মাঝরাত্রে উঠে আলো জ্বালতে গিয়ে আলো জ্বলে নি, সুইচেও নাকি শক দিচ্ছিল। মণিকা জবাবে বলে।
ঘরের মধ্যে উপস্থিত সব কজনই কৌতূহলের সঙ্গে কিরীটীর প্রশ্ন ও প্রশ্ন করার পর জবাব শুনছিল।
অন্য কেউ না বুঝলেও সুব্রত ও শিউশরণ কিরীটীর পর পর প্রশ্নগুলো শুনে বুঝতে পেরেছিল বিশেষ কোনো উদ্দেশ্যেই কিরীটী সকলকে প্রশ্ন করছে। ঘরের মধ্যেই প্রাপ্ত কোনো-না-কোনো একটা সূত্র কিরীটীকে সজাগ করে তুলেছে।
কিরীটী কিন্তু আর প্রশ্ন করে না কাউকে। হঠাৎ যেমন প্রশ্ন করতে শুরু করেছিল, হঠাৎই আবার তেমনি চুপ করে যায়। ঘরের মধ্যে সকলে চুপচাপ দাঁড়িয়ে। কারও মুখে কোনো কথা নেই। মিনিট দু-তিন নিস্তব্ধে কেটে যায়।
আবার কিরীটীই প্রশ্ন শুরু করে। এবারে ডাঃ মজুমদারকে।
মৃতদেহ দেখে মৃত্যুর কারণ আপনার কি মনে হচ্ছে ডাঃ মজুমদার?
খুব সম্ভব কোনো একটা শকে মারা গিয়েছেন।
ইলেকট্রিক শক বলে আপনার মনে হয় কি?
হতে পারে। মৃদু কণ্ঠে ডাঃ মজুমদার বলেন।
তাহলে মৃতদেহ চেয়ারে কেন? কিরীটী যেন নিম্নকণ্ঠে নিজেকেই নিজে প্রশ্নটা করে। বলতে বলতে হঠাৎ যেন গম্ভীর হয়ে কয়েক সেকেণ্ড চুপচাপ থেকে একসময় আপন মনেই নিঃশব্দে কয়েকবার মাথাটা দোলায় এবং পূর্ববৎ অনুচ্চ কণ্ঠেই বলে, তা হতে পারে! তা হতে পারে!
সকলেই যুগপৎ কিছুটা বিস্ময় ও বোকার মতই যেন কিরীটীর মুখের দিকে তাকিয়ে তার মৃদুচ্চারিত স্বগতোক্তিগুলো বোঝবার ব্যর্থ প্রয়াস পায়।
কিন্তু কিরীটী সময়ক্ষেপ করে না। অতঃপর মৃতের জামার পকেটগুলো খোঁজ করতে গিয়ে একটা পোস্টকার্ড পেল। কার্ডটা লিখেছে অতুলেরই এক বন্ধু দেরাদুন হতে। সে লিখেছে দুন এক্সপ্রেসে সে কলকাতায় যাচ্ছে। পথে কাশী স্টেশনে যেন অতুল তার সঙ্গে দেখা করে, বিশেষ প্রয়োজন আছে।
দুন এক্সপ্রেস বেলা সাড়ে তিনটে নাগাদ ক্যান্টনমেন্টে পৌঁছবে। চিঠিটা কিরীটী পকেটে রেখে দিল। তারপরে শিউশরণের দিকে তাকিয়ে স্পষ্টোচ্চারিত কণ্ঠে বলে, শিউশরণ, এবারে তুমি তোমার কাজ কর ভাই। তবে আগে একটা চাদর দিয়ে মৃতদেহটা ঢেকে দাও।
কিরীটীর নির্দেশমতই একটি বড় চাদর এনে মৃতদেহটা ঢেকে দেওয়া হল।
এবং সকলে অতঃপর কিরীটীরই ইচ্ছামত সুকান্তর ঘরে গিয়ে বসল।
৫. জবানবন্দি নেবার জন্য প্রস্তুত
জবানবন্দি নেবার জন্য প্রস্তুত হয় শিউশরণ। যার জবানবন্দি নেওয়া হবে তাকে ছাড়া অন্য সকলকে ঘর থেকে বাইরে যেতে বলা হয়।
প্রথমেই ডাক পড়ল ডাঃ রণেন চৌধুরীর।
ডাঃ রণেন চৌধুরী। বলিষ্ঠ গঠন। শিক্ষিত, বুদ্ধিমান। হত্যার অকুস্থানের সর্বাপেক্ষা নিকটে ছিল; পাশেই ঘর। দুই ঘরের মধ্যবর্তী একটি দরজা ছিল। দরজাটায় অতুলের ঘর হতে শিকল ভোলা ছিলো। ডাঃ রণেন নিহত অতুলের বিশেষ বন্ধু। দীর্ঘদিনের পরিচয়। অবিবাহিত,
অবস্থাপন্ন, বৃত্তি চিকিৎসক।
শিউশরণ তার প্রশ্ন শুরু করে, আপনি সকালে কটা আন্দাজ বাড়ি থেকে বের হয়ে যান?
সকাল নটায়। জবাব দেয় ডাঃ চৌধুরী।
রাত্রি সাড়ে এগারোটার পর খেলা শেষ হতেই ঘরে গিয়ে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়েন? কিন্তু ঘুমোবার আগে পর্যন্ত পাশের ঘরে কোনো শব্দ শুনেছিলেন?
শুনেছিলাম। কি যেন একটা কবিতা মৃদুকণ্ঠে আবৃত্তি করছে অতুল।
মাঝরাতে একবারও আপনার ঘুম ভাঙেনি?
না।
মণিকা দেবীর ডাকে এ ঘরে আজ সকালে ঢোকবার আগে পর্যন্ত ওঁর মৃত্যু সম্পর্কে কিছুই জানতেন না?
না।
ডাঃ চৌধুরী একটা কথা, আপনি জানতেন নিশ্চয়ই পরশু রাত্রে এই ঘরের আলোটা খারাপ হয়ে গিয়েছে? প্রশ্ন করে কিরীটী।
জানতাম।
আচ্ছা আলোটা ঠিক করবার জন্য কে এবং কখন ইলেকট্রিক মিস্ত্রিকে খবর দিয়েছিল জানেন কিছু?
বলতে পারি না। বোধ হয় মণিই দিয়ে থাকবে।
অতুলবাবু গতকাল বিকেলে স্টেশনে যাবেন জানতেন? কই, না তো?
হুঁ। আচ্ছা একটা কথা, কিছু মনে করবেন না—মণিকা দেবীকে আপনি ভালবাসেন নিশ্চয়ই?
বাসি।
কখনও মণিকা দেবীকে নিয়ে আপনাদের তিন বন্ধুর মধ্যে মণিকা দেবীর অনুপস্থিতিতে কোনো আলোচনা হত না?
কিরীটীর আচমকা প্রশ্নে হঠাৎ যেন ডাক্তার একটু বিহ্বল হয়েই পড়ে, কয়েক সেকেণ্ড স্তব্ধ হয়ে থাকে। পরে মৃদুচ্চারিত কণ্ঠে বলে, হয়েছে দু-একবার কিন্তু সেও উল্লেখযোগ্য এমন কিছু নয়।