কিরীটীর চিন্তাপ্রবাহে ছেদ পড়ে। সাইকেল রিকশা গলির মুখে এসে দাঁড়িয়েছে। আর এগুবে না বাকি সামান্য পথটুকু পদব্রজেই যেতে হবে।
.
প্রথমে রণেন, তার পশ্চাতে শিউশরণ ও সর্বশেষে কিরীটী কক্ষমধ্যে প্রবেশ করে। ডাঃ মজুমদার পাশের ঘরেই শিউশরণের অপেক্ষায় ছিলেন, তিনিও এগিয়ে এলেন সঙ্গে সঙ্গে। কিরীটী কক্ষমধ্যে পা দিয়ে প্রথমেই তার চিরাচরিত তীক্ষ্ণ অনুসন্ধানী দৃষ্টিতে ঘরের চারপাশে একবার চোখ বুলিয়ে নিল। মাঝারি আকারের ঘরটি। দক্ষিণ দিকটা চাপা। পুর্বে দুটি জানালা। জানলা দুটিই খোলা। যে চেয়ারটার ওপরে মৃতদেহ রয়েছে তারই হাত-দেড়েক ব্যবধানে একটা ক্যামবিসের খাটিয়ার ওপরে নিভাঁজ একটি শয্যা বিছানো। শয্যাটি ব্যবহৃত, শয্যাটিতে কেউ রাত্রে শয়ন না করলেও একটা ব্যাপার কিরীটীর দৃষ্টিকে আকর্ষণ করে, শয্যার মাঝামাঝি একটা জায়গায় শয্যার চাদরটা যেন একটু কুঁচকে আছে। বোধ হয় কেউ ঐ জায়গাটায় বসেছিল। এবং তাতে করেই বোঝা যায় শয্যায় কেউ না শয়ন করলেও কেউ শয্যায় বসেছিল। শিউশরণ মৃতদেহের সামনে এগিয়ে গিয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে বোধ হয় মৃতদেহ পরীক্ষা করছিল। এবারে সেই দিকে তাকাল কিরীটী। যে চেয়ারটার ওপরে মৃতদেহ উপবিষ্টাবস্থায় রয়েছে সে চেয়ারটা সাধারণ কাঠের নয়, স্টীলের ফ্রেমে লোহার চাদরে তৈরী। এবং চেয়ারের পাশেই ডান দিকে একখানা বই বাংলা বই, মেঝেতে পড়ে আছে। এবারে মাথার উপরে তাকাল কিরীটী। শেডে ঢাকা ইলেকট্রিক আলো। আলোটি নেভানো।
কিরীটী রণেনের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে, ডাঃ চৌধুরী, প্রথমে যিনি আজ সকালে এই ঘরে ঢুকে মৃতদেহ আবিষ্কার করেন তিনি কি ঐ আলোটা নেভানো দেখেছিলেন, না আলোটা জ্বলছিল?
ঘরের আলোটা নেভানো রয়েছে। ঘরের মধ্যে উপস্থিত সকলেই পরস্পর পরস্পরের মুখের দিকে যেন প্রশ্নভরা দৃষ্টিতে তাকায়। সকলেই একে একে জবাব দেয়—আলো নোনোই ছিল।
এবারে কিরীটী মণিকাকেই প্রশ্ন করে, আপনি তো প্রথম সকালে এ ঘরে ঢোকেন চা। নিয়ে, তখন কি আলোটা নেভানো ছিল, না জ্বলছিল?
লক্ষ্য করিনি তো!
আচ্ছা সাধারণত উনি, মানে অতুলবাবু, কি ঘরের দরজা বন্ধ করেই শুতেন?
দরজা বন্ধ করে শুত এবং প্রত্যেক দিনই সকালে ওকে ডেকে ওঠাতে হত। তাই তো আজকে ঘরের দরজা খোলা পেয়ে একটু আশ্চর্যই হয়েছিলাম। জবাবে মৃদু কণ্ঠে কথাগুলো মণিকা বলে।
কিরীটী মনে মনে ভাবে, শোবার ঘরের দরজা শয়নের পূর্বে যার চিরদিন বন্ধ করে শোয়াই অভ্যাস—কেন আজ তার দরজা খোলা ছিল? কেন?
বোঝা যায় মৃত ব্যক্তি বিছানায় শোয়নি গত রাত্রে, আগের রাত্রের সেই হাফশার্টটা পরা, চেয়ারে উপবিষ্ট অবস্থাতেই মারা গিয়েছে, চেয়ারের পাশেই মেঝেতে একটা বই—সব কিছু মিলে স্বাক্ষর দিচ্ছে শয়নের পূর্বে সে বই পড়ছিল বা পড়বার চেষ্টা করছিল এবং গত রাত্রে সেক্ষেত্রে আলোটা ঘরের জ্বলবে না কেন? কে নেভাল আলো? কেনই বা নেভাল? কেন?
আচ্ছা মণিকা দেবী! কিরীটীর ডাকে মণিকা আবার কিরীটীর মুখের দিকে তাকায়। রাত্রে কি আপনাদের বাড়ির দোতলার সিঁড়ির মুখের যে দরজাটা দেখলাম সেটা বন্ধ থাকে না?
না, খোলাই থাকে। জবাবে বলে মণিকা।
বাড়িতে বর্তমানে আপনারা কজন আছেন?
দিদিমা, সুবালাদি, ঝি জাকিয়া আর আমরা চারজন। কয়েকদিনের জন্য একটা ঠিকে চাকর রাখা হয়েছে, তা সে রাত্রে নটা-দশটার পর বাড়ি চলে যায়। রাত্রে এখানে শোয় না।
গত রাত্রে দোতলায় আপনারা কে কে ছিলেন? আবার প্রশ্ন কিরীটীর।
এই ঘরে অতুল, পাশের ঘরে রণেন, তার পরের ঘরে আমি সুবালাদি ও দিদিমা, তার পাশের ঘরে সুকান্ত।
কোন্ ঘরে বসে গত রাত্রে আপনারা সাড়ে এগারোটা পর্যন্ত তাস খেলেছেন?
সুকান্তর ঘরে।
কেউ আপনারা মনে করে বলতে পারেন, গতকাল সমস্ত দিন ও শুতে যাবার আগে পর্যন্ত সময়ের মধ্যে কখন কখন এবং কতবার অতুলবাবু বা আপনারা এঘরে এসেছেন?
প্রথমেই ডাঃ রণেন চৌধুরী বললে, সিটিতে আমার এক সহপাঠী ডাক্তার আছেন, কাল সকালে চা-জলখাবার খেয়েই আমি ক্যামেরাটা লোড করে নিয়ে বের হয়ে যাই। বেলা চারটে পর্যন্ত সেই বন্ধুর ওখানেই ছিলাম। খাওয়াদাওয়া সেখানেই করি। এখানে ফিরে আসি বেলা পাঁচটা নাগাদ। অতুল তখন বাড়ি ছিল না। আমি ফিরে আসবার আরও আধঘণ্টা পরে অতুল ফেরে। প্রায় ছটা নাগাদ আমরা গঙ্গায় নৌকা বাইবার জন্য যাই। রাত আটটায় ফিরে আমার ঘরেই সকলে বসে আড্ডা দিই। রাত নটায় খাওয়াদাওয়া সেরে তাস খেলতে বসি। সাড়ে এগারোটায় তাস খেলা ভাঙলে সোজা নিজের ঘরে শুতে যাই। ক্লান্ত ছিলাম, শোয়া মাত্রই ঘুমিয়ে পড়েছি। গতকাল দিনে বা রাত্রে একবারের জন্যও এ ঘরে আমি আসিনি। আর দেখিওনি অতুল কতক্ষণ এ ঘরে ছিল বা কবার এসেছিল।
কথাগুলো যেন জবানবন্দির মতই একটানা গুছিয়ে বলে গেল ডাঃ রণেন চৌধুরী।
অতুলবাবু বাড়ি ছিলেন না, আপনি একটু আগে বললেন, আপনি যখন বাড়ি ফেরেন। অতুলবাবু কখন বের হয়েছিলেন, কোথায় গিয়েছিলেন বা কতক্ষণের জন্য বাইরে ছিলেন জানেন কিছু ডাক্তার চৌধুরী? কিরীটী প্রশ্ন করে।
না, আমি বলতে পারি না।
মণিকা দেবী, আপনি?
বেলা দুটো পর্যন্ত সে বসে চিঠি লিখেছিল ঘরে আমি জানি। ঠিক দুটো বাজতে চিঠিগুলো ডাকে ফেলতেই বাইরে গিয়েছিল। মণিকা জবাবে বলে।