শিউশরণ হাসতে হাসতে কৌতুক করে কিরীটীকে বলে, এই নাও কিরীটী, তুমি আসার সঙ্গে সনেই হত্যাসংবাদ! চল, যাবে নাকি একবার অকুস্থানে?
কিরীটী একটা আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে বলে, না হে। তুমিই যাও।
উঁহুঁ। একা তীর্থদর্শনে পুণ্যসঞ্চয় হয় না। তোমাকেও সঙ্গী চাই। ওঠ—চল।
যাও না হে! কিরীটী এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে।
না। তোমাকেও যেতে হবে। চাই কি তুমি সঙ্গে থাকলে হয়ত অকুস্থানেই একটা ফয়সালা হয়ে যাবে। বখেড়া মিটিয়ে নেওয়াই ভাল। চল।
অগত্যা কিরীটীকে উঠতেই হল।
.
ছজন একটা সাইকেল রিকশায় যাওয়া চলে না তাই আর দুটিকে ডাকতে হল। একটায় উঠে বসে রণেন ও কিরীটী, অন্যটায় শিউশরণ ও সুব্রত, হরিকম্পাউণ্ডার ও একজন কনস্টেবল আর একটাতে।
ইতিমধ্যেই কাশী শহর কর্মচঞ্চল হয়ে উঠেছে। পূজায় এবারে লোকসমাগমও অনেক হয়েছে শহরে। রাস্তায় ও দোকানে দোকানে নানাবয়েসী স্ত্রী-পুরুষের ভিড়—তাদের মধ্যে নিত্য গঙ্গাস্নান-যাত্রীদেরও আনাগোনা চলেছে। খোদাইচৌকির থানা থেকে গোধূলিয়ার দূরত্ব খুব বেশী নয়। হেঁটে গেলে মিনিট কুড়ি-পঁচিশের বেশী লাগে না। কিরীটী তাই প্রথমটায় বলেছিল পথটুকু হেঁটেই যাবে কিন্তু শিউশরণ রাজী হয়নি।
চলন্ত রিকশায় রণেনের পাশে বসে কিরীটী নানা প্রশ্ন করছিল। কিরীটীর সজাগ তীক্ষ্ণ শ্রবণেন্দ্রিয় দুটি ওদের কথাবার্তার প্রতি নিয়োজিত থাকলেও, অন্যমনস্ক দৃষ্টিতে একটা চুরুট টানতে টানতে রাস্তার দুধারে চলন্ত জনতার প্রতি আকৃষ্ট ছিল।
আপনি বলছিলেন রাত সাড়ে এগারটা পর্যন্ত আপনারা চারজনে তাস খেলেছেন, তারপর শুতে যান যে যার ঘরে!
হ্যাঁ।
শুতে যাবার পর আপনি কোনোরূপ চিৎকার বা অস্বাভাবিক কোনো শব্দ শোনেননি?
না। সন্ধ্যায় অনেকক্ষণ গঙ্গায় দাঁড় টেনেছিলাম। খুবই ক্লান্ত ছিলাম, শুতে না শুতেই ঘুমিয়ে পড়ি। ঘুম ভাঙ্গে মণিকার ডাকে।
হঠাৎ ঐ সময় কিরীটী প্রশ্ন করেছিল, আপনি কি করেন রণেনবাবু?
আমি ডাক্তার। পাটনায় প্র্যাকটিস করি।
আপনিই কি ডক্টর আর চৌধুরীপাটনায় হার্ট ডিজিজ স্পেসালিস্ট?
হ্যাঁ। মৃদু কণ্ঠে জবাব দেয় রণেন।
আপনি নিজে যখন একজন ডাক্তার সেখানে উপস্থিত ছিলেন তখন ডাঃ মজুমদারকে আবার ডাকা হল যে? কিরীটী রণেনের মুখের দিকে তাকিয়েই প্রশ্নটা করে।
কারণ মৃতদেহ দেখেই বুঝেছিলাম, আমাদের বন্ধু অতুলের মৃত্যুটা স্বাভাবিক মৃত্যু নয়। তাছাড়া আর একটা কথাও আমার ঐ সঙ্গে মনে হয়েছে। যেভাবে বাড়ির মধ্যে মৃত্যু হয়েছে তাতে করে স্বভাবতই সকলের ধারণা হবে বাড়ির মধ্যেই কেউ আমরা তাকে হত্যা করেছি; তাই তো আমি নিজে ডাক্তার হওয়া সত্ত্বেও আর একজন বাইরের ডাক্তারকে ডাকা ও থানায় সংবাদ দেওয়াটা যুক্তিসঙ্গত বলে আমার মনে হয়েছে। দীর্ঘদিনের বন্ধুত্ব আমাদের, আমাদেরই মধ্যে একজনের এভাবে অস্বাভাবিক মৃত্যু হল কেন? আর এর জন্য আমরাই কেউ দায়ী কিনা এটাও আমাদের জানা প্রয়োজন, নয় কি?
নিশ্চয়ই। সত্যিই আপনার সৎ সাহসের আমি প্রশংসা করছি ডাঃ চৌধুরী।
সৎ সাহসের কথাটা বাদ দিলেও অতুলের মৃত্যুটা যে কত বড় মর্মান্তিক আঘাত আমাদের পক্ষে, বাইরের লোক আপনারা বুঝতে ঠিক পারবেন না কিরীটীবাবু। এবং শুধু মর্মান্তিক নয়, অত্যন্ত লজ্জারও ব্যাপার। অতুলের মৃত্যু-রহস্যের একটা মীমাংসা বিশেষভাবেই প্রয়োজন। আমাদের বিবেকের দিক থেকেও। যতক্ষণ না এই ব্যাপারের মীমাংসায় আমরা পৌঁছতে পারব ততক্ষণ আমরা পরস্পর আমাদের পরস্পরের কাছেই থাকব guilty-দোষী।
কথাগুলো বলতে বলতে ডাঃ রণেন চৌধুরী শেষের দিকে নির্বাক কিরীটীর মুখের দিকে তাকিয়ে বললে, আপনার সঙ্গে সাক্ষাৎ পরিচয় না থাকলেও আপনার নাম আমার বিশেষ পরিচিত মিঃ রায়। আজকে আমাদের এত বড় বিপদের দিনে আপনাকে এ সময়ে এখানে পাওয়ায় সত্যি বলতে কি কতখানি যে নিশিন্ত হয়েছি বলতে পারব না। আপনি বোধ হয় ভগবান-প্রেরিত। আমাদের আজকের লজ্জা ও অপমান থেকে আপনি অন্তত যদি আমাদের মুক্তি দিতে পারেন—
কিরীটী নিরুত্তর থাকে।
কিরীটী তখন মনে মনে ভাবছে।
দীর্ঘদিনের চার বন্ধু। তিনজন পুরষ একজন নারী। না জানলেও সাধারণ মানব-চরিত্রের দিক দিয়ে এটা খুবই স্বাভাবিক, পরস্পরের বন্ধুত্ব ছাড়াও তিন বন্ধুর মধ্যবর্তিনী ওই নারী বান্ধবীকে কেন্দ্র করে ঐ তিনটি পুরুষের মনে এই দীর্ঘদিনে নিশ্চয় কিছু না কিছু দুর্বলতা ছিল। আর শুধু দুর্বলতাই বা কেন, হিংসা বা একটা বিদ্বেষ গড়ে ওঠাও তেমন কিছু বিচিত্র বা আশ্চর্য নয়।
হঠাৎ কিরীটী রণেনকেই প্রশ্ন করে, ডাঃ চৌধুরী, আচ্ছা একটা কথা, আপনারা চারজনের মধ্যে কে কে বিবাহিত?
কেউ নয়। আমরা তিন বন্ধু ও মণিকা কেউই বিবাহ করিনি।
কেউ বিবাহ করেননি?
না।
কেউ বিবাহিত নয়! দীর্ঘ নয় বৎসরের বন্ধুত্ব! তিনটি কৃতবিদ্যা কুমার ও একটি কুমারী। তিন পুরুষের মধ্যবর্তিনী এক নারী। তারই মধ্যে এসেছে অস্বাভাবিক মৃত্যু।
কিরীটীর মনে হয় জীবনে ইতিপূর্বে এমন জটিল প্রশ্নের সম্মুখীন সে খুবই কম হয়েছে। স্নেহ ভালবাসা রাগ দ্বেষ হিংসা ও ঘৃণমানব-মনের গোপন অবগহনে যে সব স্বাভাবিক বৃত্তিগুলো আনাগোনা করে এক্ষেত্রে কোনটির প্রভাব পড়েছে কে জানে! আর কেমনই বা সেই মধ্যবর্তিনী নারী!