কোন রাগ ছিল না তার দেহে। সুকান্ত ও রণেন তবু মধ্যে মধ্যে অসুখে বা পেটের গোলমালে ভুগেছে, কিন্তু গত সাত আট বৎসরের মধ্যে একদিনের জন্যও অতুলকে অসুস্থ হতে দেখা যায়নি। সে সবার চাইতে বেশী পরিশ্রমী—চঞ্চলও সে তিনজনের মধ্যে সকলের চাইতে বেশী। সেই নীরোগ সুস্থ অতুল! হঠাৎ তার এমন কি হল যে হঠাৎ চেয়ারে বসে বসেই তার প্রাণ বের হয়ে গেল। প্রথমটায় প্রায় মিনিট দশেক তিনজনের মধ্যে কারও মুখেই কোন কথা সরে না। তিনজনেই যেন বোবা নিশ্চল। অতুলের মৃত্যু শুধু অভাবনীয় নয়, যেন চিন্তারও অতীত।
অনেকক্ষণ মৃত অতুলের দিকে চেয়ে চেয়ে দেখে ওরা তিনজন পরস্পরের মুখের দিকে তাকায়। সকলের বোবা দৃষ্টিতে একটি মাত্র প্রশ্ন : এ কি হল?
শরৎ-প্রভাতের সোনালী আলো মুক্ত বাতায়নপথে ঘরের মধ্যে এসে যেন সেই প্রশ্নই করছে, কি হল?
জানালার পাল্লার উপরে একটা চড়ুই পাখি লাফালাফি করে কিচিরমিচির শব্দ করছে। দিদিমা এখনও গঙ্গাস্নান সেরে বাড়ি ফেরেননি। দাই জাকীয়ার গলার স্বর শোনা যাচ্ছে, সুবালাদির সঙ্গে নিত্যকার ঘর-দুয়ার পরিষ্কার করা নিয়ে খিটিমিটি চলেছে নীচে। দিদিমার দক্ষিণ হস্ত ঐ সুবালাদি। আজ দীর্ঘ পাঁচ বছর গাঁ হতে এসে দিদিমার আশ্রয়েই থাকেন। একবেলা রান্না সুবালাদিই করেন। মণিকা ঘরে এলেও বেশীক্ষণ কিন্ত দৃশ্যটা সহ্য করতে পারে না। ঘরের বাতাসে যেন এতটুকু অক্সিজেনও নেই, কেমন যেন শ্বাসরোধ করছে।
মণিকা বারান্দায় বের হয়ে এল। রেলিংয়ের সামনে দাঁড়াল। বারান্দা থেকে বেশ খানিকটা আকাশ দেখা যায়। শরতের আকাশ। পেঁজা তুলোর মত কয়েক টুকরো মেঘ নীল আকাশের বুকে ইতস্তত সঞ্চরণশীল। প্রাণের সংবাদ নিয়ে সকালে সূর্যের আলো দিগন্ত প্লাবিত করে দিচ্ছে। এই শুচিস্নিগ্ধ প্রভাতের প্রশান্তিতে কেন মৃত্যু এল! অতুল! অতুল! গত সাতদিনের খুঁটিনাটি কথা মনে পড়ছে। গতকালও এমন সময় অতুলের ঘরে বসেই চা-পান করছিল ও।
অতুল বলছিল চা-পান করতে করতে, এ যাত্রায় তার বেশীদিন থাকা হবে না, দু-চারদিনের মধ্যেই এবারে তাকে বম্বে রওনা হতে হবে। সেখানে কিসের একটা কনফারেন্স আছে। পরশুদিন সকলে মিলে সারনাথ গিয়েছিল। রণেন ও সুকান্ত ভিতরে ছিল, মণিকা আর অতুল বাইরে বেড়াচ্ছিল। সূর্যের শেষ আলোটুকু নিঃশেষ হতে চলেছে তখন পৃথিবীর বুক হতে।
চারদিকে আবছা আলোর একটা স্লান বিধুর বিষণ্ণতা। অতুল হঠাৎ বললে, একটা কথা এবারে আমি তোমাকে বলব স্থির করেছি মণি।
কৌতুকস্মিত কণ্ঠে মণিকা জবাব দিয়েছিল, বলবেই যখন স্থির করেছ অতুলানন্দ স্বামী, বলেই ফেল চটপট। মনের মধ্যে আর পুষে রেখো না। বেশীক্ষণ পুষে রাখলে জমাট বেঁধে যাবার আবার ভয় আছে।
না, না—ঠাট্টা নয়—
ঠাট্টা যে নয় সে তো বুঝতেই পারছি। তবে আর বিলম্ব কেন? বলেই ফেল। হাসতে হাসতে জবাব দিয়েছিল মণিকা।
আমি বিবাহ করব স্থির করেছি কথাটা যেন কোনমতে উগরে দেয় অতুল।
সুসংবাদ। কবে? কৌতুকস্নিগ্ধ দৃষ্টিতে তাকায় মণিকা অতুলের মুখের দিকে।
যবে কনে বলবে প্রস্তুত–সেই দিনই।
কেন, কনে কি এখনও প্রস্তুত নয়? আবার সেই কৌতুক জেগে ওঠে মণিকার কণ্ঠে।
বুঝতে পারছি না।
বল কি! তবে কি রকম বিয়ের ঠিক করলে? হাসতে শুরু করে মণিকা, কনের মনের সংবাদই এখনও মিলল না, অথচ স্থির করে ফেললে বিয়ে করছ!
তাই তো কনেকে শুধাচ্ছি—
বুঝেও যেন না বোঝার ভান করে মণিকা বলে, মানে?
সেই জবাবই তো চাই তোমার কাছে মণি—
ক্ষণকাল মণিকা চুপ করে থাকে। তারপর বলে, আমার জবাব তো তুমি পেয়েছ অনেক দিন আগেই অতুল। আমি তোমাদের তিনজনকেই ভালবাসি। এবং সেই ভালবাসার মধ্যে
আমি বিচ্ছেদ বা দুঃখ আনতে চাই না।
এ ধরণের platonic ভালবাসার কোন অর্থই হয় না। আর জান, এ ভালবাসায় আমি তৃপ্তও নই। আমি চাই আমার ভালবাসাকে পরিপূর্ণভাবে একান্তভাবে আমারই করে পেতে। জীবনের সর্ব ব্যাপারে ভাগ দিতে ও ভাগীদার হতে আমি রাজী আছি, কিন্তু ভালবাসার ব্যাপারে নয়।
কিন্তু এতদিন তো তুমি তাতেই তৃপ্ত ছিলে, অতুলানন্দ!
না। সে তোমার ভুল।
ভুল?
হ্যাঁ, একেবারেই ভুল।
এরপর নিঃশব্দে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে মণিকা, তারপর বলে, আমাকে তুমি ক্ষমা কর অতুল।
না, না। না, আজ আমার কথা তোমায় শুনতেই হবে মণি।
মণিকা নির্বাক।
কি, চুপ করে রইলে যে?
কি বলব বল। সবই তো তোমরা জান। আমাকে পাওয়ার চিন্তা তুমি ভুলে যাও।
তা আর সম্ভব নয় মণি। গত তিন বৎসর যুদ্ধ করে নিজের সঙ্গে আমি আজ ক্ষতবিক্ষত। এই আমার শেষ সঙ্কল্প। আমি তোমায় চাই। অতুল হাত বাড়িয়ে আবেগের সঙ্গে মণিকার একখানা হাত অন্ধকারেই চেপে ধরে, মণি!
হাত ছাড় অতুল। অধীর হয়ো না। এত বড় বন্ধুত্বকে ক্ষুন্ন হতে দিও না।
হঠাৎ এমন সময় শুকনো পাতার উপর কার যেন দ্রুত পলায়মান পদশব্দ শোনা গেল। দুজনেই চকিত হয়ে প্রশ্ন করে, কে? কে?
ইতিমধ্যে দুজনের একজনের খেয়াল হয়নি কখন একসময় সন্ধ্যার অন্ধকারে চারদিক ঢেকে গিয়েছে।
খেয়াল হতেই মণিকা বলে ওঠে, উঃ, দেরি হয়ে গিয়েছে। কিন্তু রণেন আর সুকান্তর এখনও কোন পাত্তা নেই কেন? ওরা আবার কোথায় গেল?
অল্প দূরেই এমন সময় সুকান্তর গলা শোনা যায়, অতুল, মণি,তোমরা কোথায়? বাড়ি ফিরবে না? টাঙ্গাওয়ালা যে তাগাদা দিচ্ছে।