মণিকা ঠাট্টা করে বলেছিল, উঁহু, এ ঠিক তা নয়। এ অনেকটা দুধের সাধ ঘোলে মেটানো আর কি!
একত্রে যুগপৎ সকলেই প্রশ্ন করে, তার মানে, তার মানে?
উঁহুঁ। Thus far and no further! কতকগুলো এমন ব্যাপার আছে সংসারে যার রহস্যটুকু উদঘাটিত হয়ে গেলেই সকল মাধুর্য তার নষ্ট হয়ে যায়।
এই ব্যাপরের পরেই কিন্তু একটি বিচিত্র ব্যাপার ঘটে। যদিচ তিন বন্ধু জানে আজ পর্যন্ত একজন ব্যতীত বাকী দুজন সে ঘটনা সম্পর্কে একেবারে সম্পূর্ণ অজ্ঞ। কিন্তু মণিকা জানে তিন বন্ধুর প্রত্যেকেই আলাদা আলাদা করে তাকে একই অনুরোধ জানিয়েছে এবং প্রত্যেককেই মণিকা একই জবাব দিয়ে মৃদু হাসির সঙ্গে নিবৃত্ত করেছে। ব্যাপারটা হচ্ছে মণিকার বন্ধুদের ঐ ধরনের সম্বোধনের কিছুদিন পরেই একদিন অতুল বলে, মণিতুমি নিশ্চয়ই জান আমাদের চারজনের বন্ধুত্বের মধ্যে কোথাও এতটুকু গলদ নেই। তোমার সেদিনকার রহস্যজনক উক্তি বুঝতে পারিনি মনে কোরো না।
মণি কৌতুক হাস্যের সঙ্গে অতুলের মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে, বুঝতে পেরেছ! কি বল তো অতুলানন্দ স্বামী?
সত্যি, ঠাট্টা নয়! Be serious মণি!
I am seriousgo on! মণি গম্ভীর হবার ভান করে।
তুমি যদি আমাদের তিনজনের মধ্যে কাউকে বিয়ে কর, জেনো, বাকি দুজন আমরা এতটুকুও দুঃখিত হব না।
সত্যি বলছ?
ভগবানের নামে শপথ নিয়ে বলছি, সত্যি।
নাস্তিকের মন নিয়ে আর ভগবানকে টানাটানি কোরো না অতুলানন্দ স্বামী।
বিশ্বাস কর আমি যা বলছি—
করলাম, কিন্তু আমার নিজস্ব একটা মতামতও তত থাকতে পারে এ ব্যাপারে!
নিশ্চয়ই।
তাহলে শোন, বিধাতা এ জীবনে বোধ হয় আমার ঘর বাঁধার ব্যাপারে বিষম একটা কৌতুক করে বসে আছেন!
মানে?
মানে তোমাদের তিনজনের মধ্যে এমন বিশেষ বিশেষ কতকগুলো গুন আছে, একমাত্র যাদের সমম্বয়েই আমি বিবাহে স্বীকৃত। অতএব বুঝতেই পারছ তা যখন এ জীবনে হবার নয় তখন–
তাহলে আর কি হবে? তাই তো ভেবেছি এ জীবনের তপস্যা পরজন্মে মনোমত পতিলাভ।
পরে রণেন ও সুকান্তও ঠিক অনুরূপ অনুরোধই জানিয়েছিল মণিকাকে এবং মণিকাও পূর্ববৎ জবাবই দিয়েছিল তাদেরও।
কিন্তু মণিকার সম্বন্ধেও অতুল কোনো সাড়া দেয় না। আরও একটু এগিয়ে এসে মণিকা বলে, কি গো অতুলানন্দ স্বামী, চেয়ারে বসে ঘুমোচ্ছ নাকি?
এবারেও সাড়া না পেয়ে ভাল করে তাকায় মণিকা অতুলের দিকে এবং সঙ্গে সঙ্গে চমকে ওঠে ও, হাত হতে চা-ভর্তি কাপটা মাটিতে পড়ে ঝঝন্ শব্দে গুঁড়িয়ে যায়। অত্যন্ত ধীরস্থির মণিকা চিরদিন সাধারণত মেয়েরা যে স্নায়বিক হয় অদপেই সে ধরনের সে নয়। কিন্তু সেই মুহূর্তে শিথিল হাত হতে চায়ের কাপটা পড়ে মাটিতে চূর্ণ হয়ে যাবার ঠিক পূর্বে ক্ষণেকের জন্য সম্মুখেই উপবিষ্ট নিশ্চল অতুলের মুখের দিকে তাকিয়েই যেন একটা ভয়ের অনুভূতি তাকে বিকল করে দিয়েছিল। অস্ফুট একটা আর্ত শব্দ কোনমতে চাপতে চাপতে ছুটে ঘর হতে বের হয়ে চাপা উত্তেজিত কণ্ঠে ডাকে, রণেন, সুকান্ত-শীগগিরী!
সুকান্ত সবে তখন চায়ের কাপটি শেষ করে নামিয়ে রাখতে যাচ্ছিল শয্যার পাশেই মেঝেতে হাত বাড়িয়ে এবং শয্যা হতে তখনও সে গাত্রোখান করেনি। আর রণেন চায়ের কাপ অর্ধেক নিঃশেষ করেছে। মণিকার চাপা আর্ত ডাকটা উভয়েরই কানে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গেই দুজনেই প্রায় একসঙ্গে দুঘর হতে বের হয়ে আসে সামনের বারান্দায়। মণিকার সর্বশরীরতখনও উত্তেজনায় কাঁপছে। একবার মাত্র ওদের ডেকেই যেন তার সমস্ত শক্তি নিঃশেষ হয়ে গিয়েছে। সমস্ত মুখখানা তার ভয়ে ও উত্তেজনায় কেমন হয়ে গিয়েছে। একটা বিবশ অসহায় নিষ্ক্রিয়তা।
দুজনেই ব্যগ্র কণ্ঠে প্রশ্ন করে, কি? কি হয়েছে মণি?
অতুল—কোনক্রমে মণিকা বেল নামটাই উচ্চারণ করতে সক্ষম হয়।
অতুল! কি হয়েছে অতুলের? সুকান্ত প্রশ্ন করে, কিন্তু রণেন ততক্ষণে খোলা দরজা দিয়ে অতুলের ঘরে গিয়ে প্রবেশ করে।
কি? কি হয়েছে অতুলের? সুকান্ত আবার প্রশ্ন করে।
কিন্তু মণিকার কণ্ঠে কোন জবাব আসে না। কেবল ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে সুকান্তর মুখের দিকে, অগত্যা সুকান্তও ঘরের মধ্যে যায়। মণিকা তাকে অনুসরণ করে আচ্ছন্নভাবে যন্ত্রচালিতের মত।
নির্বাক স্থির জড়পদার্থের মত দাঁড়িয়ে আছে রণেন চেয়ারের উপরে উপবিষ্ট অতুলের মুখের দিকে তাকিয়ে।
অতুল!
অতুলের গায়ের রঙ উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ। কিন্তু মুখের দিকে তাকালে মনে হয় যেন সমস্ত মুখখানার ওপরে একটা কালো ছায়া পড়েছে। চোখ দুটি খোলা এবং আতঙ্কে বিস্ফারিত দুহাত মুষ্টিবদ্ধ—অসহায় শিথিলচেয়ারের দুপাশে ঝুলছে। হাঁটু দুটো একটু ভাঁজ করা। বারেক মাত্র তাকিয়েই কারও বুঝতে কষ্ট হয় না যে অতুল মৃত। ডাক্তার রণেনের পক্ষে তো নয়ই, সুকান্তরও বুঝতে দেরি হয় না অতুল মৃত।
গত রাত্রে আহারাদির পর সাড়ে নটা থেকে সাড়ে এগারোটা পর্যন্ত চারজনে একত্রে সুকান্তর ঘরে বসে তাস খেলেছে। এবং তাস খেলতে খেলতে প্রত্যহ যেমন হৈ-হুল্লোড় হাসি তামাসা হয় তেমনিই হয়েছে। বরং গত রাত্রে যেন একটু বেশীই কৌতুকপ্রিয় দেখা গিয়েছিল অতুলকে। এমনিতেই কারণে অকারণে অতুল একটু বেশী হাসে, গত রাত্রে তার সে হাসির মাত্রা যেন অন্যান্য দিনের চাইতে একটু বেশীই বলে মনে হচ্ছিল। প্রাণপ্রাচুর্যে ভরা অতুল।