এদের তিনজনের মধ্যে অতুল ধনী পিতার পুত্র। নিজেও মেধাবী ছাত্র হিসাবে অল্প বয়সেই ভাল চাকরি পেয়েছে। রণেন কিছুদিন হল বিলাতী ডিগ্রী ডিপ্লোমা নিয়ে এসে একজন তরুণ চিকিৎসক হিসাবে ক্রমে চিকিৎসা-জগতে নাম করতে শুরু করেছে। রণেনের আর্থিক অবস্থা ভাল না হলেও মোটামুটি। ছাত্র হিসাবে সেও বরাবর মেধাবী ও বৃত্তি পেয়ে এসেছে। দুজনের চেহরার মধ্যে কারোরই এমন বিশেষ কিছু আকর্ষণীয় ছিল না। তবে স্বভাবে দুজনেই নম্র, বিনয়ী, ধীর ও সহিষ্ণু। তৃতীয় বন্ধু সুকান্ত গরীবের ছেলে, বাপ গরীব স্কুলমাস্টার। বাপের ক্ষমতা ছিল না ছেলেকে খরচপত্র করে উচ্চশিক্ষায় মনোমত উচ্চশিক্ষিত করে তোলেন। কিন্তু সুকান্তর ভাগ্যক্রমে তার এক সহায় জুটেছিল নিঃসন্তান এক ধনবতী মাসী। মাসী তার মায়েরও বড়। সুকান্তরা চার ভাই ও পাঁচ বোন। ভাই বোনদের মধ্যে সুকান্ত তৃতীয়। সুকান্তকে একপ্রকার দত্তক পুত্রের মতই বরাবর তার মাসী নিজের কাছে রেখে খাইয়ে পরিয়ে মানুষ করে তুলেছেন। সুকান্ত ইঞ্জিনীয়ারিং পাস করে একটি বিলাতী ইলেকট্রিক্যাল ফার্মের বড় চাকুরে, মেসোরই সুপারিশে ভাল চাকুরিতে ঢুকেছে প্রায় বছর দেড়েক হল। সুকান্ত তিন বন্ধুর মধ্যে সবচেয়ে সুশ্রী। দীর্ঘ পেশল চেহারা, গোরাদের মত টকটকে গায়ের রং। আরও একটি তার গুণ আছে, সে একজন সুকণ্ঠী এবং সুগায়কও। আর মণিকা? মণিকার গায়ের রং কালো হলেও সমগ্র দেহ এমন একটি লাবণ্যে ঢলঢল, বিশেষ করে মুখখানি, তার বুঝি তুলনা হয় না। রোগাটে চেহারায় এমন একটি সৌন্দর্যময়ী সজীবতা আছে যে মনে হয় জীবনপাত্রখানি তার বুঝি সুধারসে উছলে উঠছে। সৌন্দর্যময়ী, মাধুর্যময়ী ও লাবণ্যময়ী।
রণেন, সুকান্ত ও অতুল এদের কলেজে আই.এস-সি ক্লাসেই পরিচয়। পূজার ছুটিতে ও গ্রীষ্মের ছুটিতেই বরাবর তিন বন্ধুতে মিলে কোন-না-কোন জায়গায় গিয়ে কিছু হৈচৈ করে আসত। অমনি এক পূজার ছুটিতেই পুরীতে বেড়াতে গিয়ে সমুদ্রসৈকতেই ওদের প্রথম পরিচয় হয় মণিকার সঙ্গে। মণিকা তখন বি.এ. পড়ছে। মণিকারও অভ্যাস ছিল পূজার ছুটিতে কোথাও-না-কোথাও বেড়াতে যাওয়া। দেশভ্রমণের একটা অদ্ভুত নেশা বরাবরই তার ছিল তার সেই ছোটবেলা থেকেই। পুরীর সেই আলাপ ক্রমে ঘনিষ্ঠতায় পরিণত হয়। ছুটির পর কলকাতায় ফিরে এসে চারজনের দেখাসাক্ষাৎ হওয়াটা ছিল একটা নিত্যকার ব্যাপার এবং প্রতি রবিবারের ছুটিটা বটানিকসে বা ডায়মণ্ডহারবারে অথবা নৌকো করে গঙ্গায় কিংবা দক্ষিণেশ্বরে—কোথাও-না-কোথাও সারাটা দিন হৈচৈ করেই কাটত ওদের চারজনের। একটি মেয়ে ও তিনটি পুরুষের মধ্যে এই হৃদ্যতা বেশ যেন বিচিত্র। এমনি করে ক্রমে অনেকগুলো বছর কেটে গেল। শিক্ষা-সমাপনান্তে এক-একজন যে-যার কর্মপথে এগিয়ে গেল, ছাড়াছাড়ি হল চারজনের মধ্যে। অতুল গেল হুগলী কলেজে প্রথমে, সেখান হতে কুচবিহারে; রণেন পাটনায় প্র্যাকটিস করতে লাগল, সুকান্ত রইল কেবল কলকাতায়। মণিকা চাকরি নিয়ে গেল দিল্লীতে। কিন্তু পূজা-অবকাশে ঠিক চারজনে কোথাও-না-কোথাও একত্রে এসে মিলিত হত। সমস্ত ছুটিটা হৈচৈ করে কাটিয়ে তারপর এক বৎসরের জন্য যে-যার কর্মস্থানে যেত ফিরে। কেবল সুকান্তই বেশীদিন থাকতে পারত না। দিন–দশেক পরে সে কলকাতায় ফিরে যেত। এইভাবে তাদের পরস্পরের পরিচয়ের ঘনিষ্ঠতায় দীর্ঘ আট বৎসর কেটে গিয়েছে। এবারে মণিকার আমন্ত্রণে সকলে পূজার ছুটিতে কাশীতে এসে মিলিত হয়েছে। এবং দুর্ঘটনাটা ঘটল সাতদিন পরে। ঠিক কোজাগরী পূর্ণিমার দিনতিনেক পরে রাত্রে।
২. অভাবনীয় আকস্মিক দুর্ঘটনা
দিদিমার বাড়ির ঘরগুলো স্বল্পপরিসর বলেই মণিকা প্রত্যেকের জন্য আলাদা আলাদা ঘরের ব্যবস্থা করেছিল শয়নের। একটা ঘরে দিদিমার সঙ্গে মণি নিজের শয়নের ব্যবস্থা করেছিল। বাকী তিনটি ঘরে তিনজনের শোবার ব্যবস্থা। দোতলায় ইংরাজী Eপ্যাটার্নের পরিকল্পনায় চারখানি ঘর। প্রথম ঘরটিতে অতুল, দ্বিতীয় ঘরে রণেন, তৃতীয় ঘরে মণি, তার দিদিমা ও সুবালাদি এবং শেষঘরে সুকান্ত। রাত সাড়ে এগারোটার পরে তাস খেলা শেষ হলে যে-যার ঘরে শুতে যায়। পরের দিন প্রত্যুষে মণি অন্যান্য দিনের মত প্রভাতী চা তৈরী করে প্রথমে ঘুম ভাঙিয়ে সুকান্তকে চা দেয়, তারপর ডেকে তোলে রণনকে এবং চা দেয়। সর্বশেষে অতুলের ঘরের ভেজানো দ্বার ঠেলে ভেতরে ডাকতে গিয়ে দেখে অন্যান্য দিনের মত তার দরজায় ভিতর হতে খিল ভোলা নেই; ভোলাই আছে। একটু যেন আশ্চর্যই হয় মণিকা, অতুলের চিরদিনের অভ্যাস—সে কখনও শয়নঘরের দরজা ভিতর হতে বন্ধ না করে শোয় না। এখানে আসবার পরও গত সাতদিন সকালে অন্তত চার-পাঁচবার দরজায় ধাক্কা দিয়ে ডেকে তবে মণিকে দরজা খোলাতে হয়েছে। দরজা প্রথম ধাক্কাতেই খুলে যেতে বেশ একটু বিস্মিত হয়েই চায়ের কাপ হাতে মণি অতুলের ঘরে গিয়ে প্রবেশ করে।
অতুল চেয়ারের ওপর বসে আছে। চায়ের কাপটি হাতে এগুতে এগুতে ঠাট্টা করেই মণি বলে, কি ব্যাপার বল তো অতুলানন্দ স্বামী!
তিন বন্ধুর সকলের নামের সঙ্গে একটা নন্দ যোগ করে স্বামী বলে ডাকে মণি। ওরা তিন বন্ধুই প্রতিবাদ জানিয়েছিল, আমরা ত্রয়ী ঘোরতর সংসারী। স্বামীজী মোটেই নয়!