পূর্বেই বলেছি অতুলবাবুকে হত্যা করা হয় বৈদ্যুতিক কারেন্ট প্রয়োগে। ইলেকট্রিক মিস্ত্রী রণলালের পক্ষে হাইভোল্টের পরিকল্পনাটি কার্যকরী করা সহজই ছিল এবং সম্ভবতপরিকল্পনাটি তার মাথায় আসে যত রাজ্যের ট্র্যাশ ইংরাজী পেনী সিরিজের গোয়েন্দা কাহিনীর বাংলা অনুবাদ পড়ে পড়ে। কিন্তু যাক সে কথা। এবারে হত্যার ব্যাপারে ফিরে আসি।
অতুলবাবুর ঘরে বসবার লোহার চেয়ারটার পায়ার সঙ্গে ও ঘরের অলোর সুইচবোর্ডের সঙ্গে একটা তামার পাত ও তারের সাহায্যে যোগাযোগ করে রাখা হয়েছিল এমন ভাবে যে, বেচারী অতুলবাবু ঘরে ঢুকে আলো জ্বেলে ইলেকট্রিক কারেন্টে তরঙ্গায়িত সেই চেয়ারটায় একটিবার গিয়ে বসলেই আর তাঁর পরিত্রাণ থাকবে না। Direct 220 Volt. A.C. current—অপূর্ব, নিষ্ঠুর, অব্যর্থ মৃত্যুফাঁদ। এইখানে হত্যাকারী একটু risk নিয়েছে। যদি অতুলবাবু চেয়ারে একেবারেই না সে রাত্রে বসতেন! সেই ভেবেই হত্যাকারী পূর্ব হতেই বোধ হয় অতুলবাবুর ঘরে ঢুকে অন্ধকারে তাঁর শয্যার উপরে নিঃশব্দে বসেছিল অতুলবাবুর অপেক্ষায়।
অতুলবাবু ঘরে ঢুকে আলো জ্বেলেই ঘরের মধ্যে হত্যাকারীকে দেখতে পেয়ে বোধ হয় চমকে যান। এবং খুব সম্ভবত তখন হত্যাকারী সুবালা অতুলবাবুকে চেয়ারটায় উপবেশন করতে বলে। কোনরূপ সন্দেহ না করে অতুলবাবু হয়ত চেয়ারে গিয়ে বসেন আর সঙ্গে সঙ্গেই তাঁর মৃত্যু ঘটে। তাড়াতাড়ি তখন সুইচ অফ করে সুবালা রণলালের নির্দেশমত মৃত্যুফাঁদের সাজসরঞ্জাম সরিয়ে নিয়ে ঘরের মাঝের দরজা দিয়ে অর্থাৎ রণেনবাবুর ঘরের ভেতর দিয়ে পালায়।
মানসিক চাঞ্চল্যে এইখানে হত্যাকারী মারাত্মক তিনটি ভুল করে। এক নম্বর অতুলবাবুকে যে রাত্রে শয়নের পূর্বে চেয়ারে বসে কিছুক্ষণ পড়াশুনা করেন সেই তথ্যটি পূর্ব হতে জানা থাকায় এবং লোকের মনে সেই ধারণা জন্মাবার জন্য চেয়ারের পাশে একখানা বই ফেলে রেখে যায় যেটা হয়ত নিজেই সে রাত্রে সে পড়েছিল ও তার হাতে ছিল। ভুল করেছিল অতুলবাবুর সুটকেস থেকে সাধারণত যে ধরনের বই তাঁর প্রিয় যেমন সাইকোলজি ও সেকলেজির কোন একখানা বই সেখানে না রেখে তারই অর্থাৎ হত্যাকারীরই বহু-পঠিত প্রিয় চরিত্রহীন উপন্যাসখানা সেখানে ফেলে রেখে গিয়ে। দু নম্বর ভুল করে সে চেয়ারের পায়া থেকে তামার পাতের রিংটা না খুলে নিয়ে গিয়ে ও সুইচবোর্ডের সঙ্গে যুক্ত তারের সবটুকু খুলে নিতে না পারায়, তাড়াতাড়ি টানাটানিতে বোধ হয় তারের একটা অংশ সুইচ-বোর্ডে লেগেছিল ছিঁড়ে গিয়ে। তিন নম্বর ও সর্বাপেক্ষা মারাত্মক ভুল করে সে মানসিক চাঞ্চল্যে সাধারণ দ্বারপথটা না ব্যবহার করে ঘরের মধ্যবর্তী দ্বারপথটা যাবার সময় ব্যবহার করে। সে হয়ত কল্পনাও করেনি ঘরের মধ্যে ঐ সময় ঠিক অন্ধকারে রণেনবাবু এসে প্রবেশ করেছেন। সোজা পথে ঘর হতে বের হলে ঐ সময় বারান্দায় তাকে কেউ দেখলেও হয়ত অতটা সন্দেহ জাগত না।
এমন সময় রণেনবাবুই প্রশ্ন করেন, কিন্তু মিঃ রায়, আপনি জানলে কি করে যে সুবালা দেবীই হত্যাকারী?
কিরীটী জবাব দিল, দুটি কারণে। প্রথমত অতুলবাবুর ডায়েরী পড়ে এবং দ্বিতীয়ত মৃত অতুলবাবুর চেয়ারের সামনে চরিত্রহীন উপন্যাসখানা পেয়ে। প্রথমটায় চরিত্রহীন উপন্যাসটা আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করেনি। কিন্তু অতুলবাবুর সুটকেস ঘাঁটতে গিয়ে তার মধ্যে কয়েকখানা সেকসোলজি ও সাইকোলজির বই দেখে চেয়ারের কাছে মাটির ওপরে পড়ে থাকা বইখানা আবার আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এবারে গিয়ে বইখানা তুলে নিয়ে দেখি শরৎচন্দ্রের চরিত্রহীন। পূর্বেই শুনেছিলাম অতুলবাবু সাইকোলজির প্রফেসর। সাইকোলজির প্রফেসর অতুলবাবু রাত জেগে চরিত্রহীন উপন্যাস পড়বেন কেমন যেন মনে খটকা লাগল।
এই সময় হঠাৎ রণেনবাবু বলে ওঠেন, বাংলা উপন্যাস বা বই বড় একটা ও পড়তই না। বিশেষ করে নভেল বা উপন্যাস ছিল তার দুচক্ষের বিষ।
আমারও সেই রকমই মন বলেছিল, যাহোক কৌতূহলভরেই বইখানার পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে একটা পাতার মার্জিনে দেখলাম রিমার্ক পাস করা হয়েছে—কিরণময়ী, দুঃখ করো না , উপীন্দ্র নপুংসক। হাতের লেখা দেখে বুঝলাম কোন স্ত্রীলোকের রিমার্ক। এই ধরনের টিপ্পনী করা অভ্যাস বই পড়ে নারীদেরই সাধারণত থাকে বা ঐজাতীয় মনোবৃত্তিসম্পন্ন পুরুষদের থাকে। তাছাড়া বইয়ের প্রথমেই টাইটেল পেজে ছোট্ট করে এক জায়গায় লেখা ছিল সুবালা। বুঝলাম সেটা তারই বই। সমস্ত ব্যাপারটা যোগ করে ভাবতে গিয়ে মনে হল যেভাবেই হোক ঐ হত্যারহস্যের মধ্যে সুবালার অন্তত কিছুটা যোগাযোগ আছেই। কিন্তু সকলের জবানবন্দি থেকে কোন কিনারা হল না।
সন্দেহ পড়েছিল আমার রণেন ও সুবালার ওপরেই বেশী। অথচ এও বুঝেছিলাম একাকিনী সুবালার পক্ষে এ হত্যা ঘটানো সম্ভবপর নয়। সুবালা সুন্দরী যুবতী। পুরুষ মাত্রেই তার প্রতি আকৃষ্ট হওয়া অসম্ভব কিছু নয়। কিন্তু কার সাহায্য নিল সুবালা। স্বভাবতই মনে হল সুবালা যদি কারও সাহায্য নিয়ে থাকে তো সে আশেপাশেরই কোন যুবক হবে। তাই হানা দিলাম সর্বপ্রথমেই পাশের বাড়িতে। রণলালের সাক্ষাৎ মিলল এবং তার সঙ্গে কথায়বাতায় বুঝলাম, সুবালার প্রতি রণলাল যে বিরাগ দেখাচ্ছে সেটা আসল সত্য নয়। অভিনয় মাত্র। যাতে তাদের ওপরে কারও সন্দেহ না পড়ে। কিন্তু তা যেন হল, সুবলাই যদি হত্যা করে থাকে, তার movemets ধোঁয়াটে জবানবন্দিতে পরিষ্কার হয়নি। তাই গঙ্গার ঘাটে আজ রাত্রের অভিনয়ের আয়োজন। কিন্তু তাতে একটা ব্যাপার প্রমাণিত হলেও সুবালার ব্যাপারটা হল না। কারণ মণিকা দেবীকে shield করবার জন্য রণেন ও সুকান্তবাবু তখনও সত্যি কথা সবটুকু বললেন না।