বলতে বলতে অতর্কিতে রণলাল ঝাঁপিয়ে পড়ে সুবালার ওপরে এবং তার কণ্ঠ টিপে ধরে দুহাতে। কিন্তু কিরীটী সতর্ক ছিল, নিমেষে সে এগিয়ে দুজনের মধ্যখানে এসে পড়ে এবং বলপ্রয়োগে রণলালকে ছাড়িয়ে দেয়। রণলালকে পুলিসের প্রহরায় অতঃপর একটা চেয়ারের উপর বসিয়ে কিরীটী বলে, বসুন রণলালবাবু। প্রেমের গতিটা বড় কুটিল! চরিত্রহীনের দিবাকরকে বুঝেও যে কেন আপনি বুঝতে পারলেন না, সত্যিই লজ্জার কথা। কিরণময়ী দিবাকরকে ভালবাসেনি কোনদিনও, ভালবেসেছিল সে উপেনকেই অর্থাৎ অতুলবাবুকেই।
সুবালাদি! মণিকার কণ্ঠ হতে কথাটা আর্ত চিৎকারের মতই শোনাল।
হ্যাঁ, মণিকা দেবী। বিধবা কিরণময়ীর উপেনকে সেই ভালবাসাই হল কাল। হতভাগিনী কিরণময়ী যেমন জানত না যে উপনের সমস্ত মন জুড়ে ছিল পশু বৌঠান, তেমনি সুবালাও জানতেন না যে অতুলের সমস্ত মন জুড়ে ছিল মণিকা দেবী। তাছাড়া আরও একটা মারাত্মক ভুল সুবালা করেছিলেন, স্বৈরিণীর মত উপচিকা হয়ে নিজেকে এক শিক্ষিত মার্জিত অন্যের প্রেমে অন্ধ পুরুষের সামনে দাঁড় করিয়ে।
আবার রণলাল চেঁচিয়ে ওঠে, স্বৈরিণী! মনে মনে তবে তুই অতুলকেই চেয়েছিস! আমাকে নিয়ে কেবল খেলাই করেছিস! উঃ! কি বোকা আমি! কি বোকা!
হ্যাঁ, বড় মারাত্মক খেলা! মৃদু হেসে কিরীটী বলে।
কিন্তু তবে—তবে সুবালাদি অতুলকে খুন করলে কেন? আবার মণিকাই প্রশ্ন করে।
সেটা সুবালা দেবী বলতে পারবেন না হয়ত। কিন্তু আমি জানি। কিন্তু আজ আর নয়। রাত পোহাল। এবারে আপনারা বাড়ি যান সকলে।
সমস্ত দৃশ্যটার উপরে কিরীটী তখনকার মত একটা পূর্ণচ্ছেদ টেনে দিতে চাইল।
কিন্তু শেষটুকু না শুনে কেউ যেতে রাজী নয়।
কিরীটী তখন অদূরে পাষাণপ্রতিমার মত নিশ্চল উপবিষ্ট সুবলার দিকে আর একবার তাকাল।
হতাশা অপমান ও দুর্নিবার লজ্জায় উপবিষ্ট সুবালার মাথাটা বুকের উপরে ঝুলে পড়েছে।
নিষ্ফলা এক নারীর পক্ষে এ যে কত বড় মর্মঘাতী কিরীটী তা বুঝতে পারে। মৃদুকণ্ঠে তাইসে শিউশরণকে লক্ষ্য করে বললে, এদের দুজনকেই তাহলে অন্যঘরে রেখে এস শিউশরণ।
শিউশরণের নির্দেশে তখন রণলাল ও সুবালা স্থানান্তরিত হল।
তাহলে এবারে আপনাদের বলি সব কথা। কিরীটী বলতে শুরু করে ব্যর্থ প্রেমের এক মর্মন্তুদ কাহিনী। হতভাগিনী সুবালা! I pity her! জ্বলন্ত আগুনের মত রূপ নিয়ে এসেও সে হল নিষ্ফলা। কিন্তু যৌবন তার সহজাত কামনার স্ফুলিঙ্গ জ্বালিয়ে দিল তার দেহ ও মনে। সেই অতৃপ্ত কামনার আগুন বুকে নিয়ে সুবালা এসে মণিকা দেবীর দিদিমার কাছে আশ্রয় নিল। দিন কেটে যাচ্ছিল একরকম করে, এমন সময়ে পাশের বাড়ির রণলাল চৌধুরী সুবালার সামনে এসে দাঁড়াল। সুবালার আগুনের মত রূপে রণলাল মুগ্ধ পতঙ্গের মতই পুড়ে ঝলসে গেল কিন্তু অর্ধশিক্ষিত মিস্ত্রী রণলাল সুবালার মনকে পুরোপুরি আকর্ষণ করতে পারল না। বোধ হয় রুচির সংঘাত।
সুবালার মনের মধ্যে ছিল একটা পরিচ্ছন্ন রুচিবোধ, তাই সে তার অতৃপ্ত যৌনকামনায় জ্বলতে থাকলেও রণলালকে গ্রহণ করতে পারলে না মন থেকে। কিন্তু একেবারে হাতছাড়াও করলে না সম্ভবত রণলালকে। মুগ্ধ পতঙ্গকে আকর্ষণ করবার যে এক ধরনের তৃপ্তি—পুরুষকে আকর্ষণ করবার যে সহজাত নারীতৃপ্তি মনে মনে সেটাই সুবালা উপভোগ করতে লাগল রণলালকে দিয়ে। কিন্তু হতভাগ্য প্রেমমুগ্ধ রণলাল সুবালার মনের আসল সংবাদ না পেয়ে মনে মনে ভাবতে লাগল, সুবালা তার করায়ত্ত!
এমনি যখন অবস্থা, মণিকা দেবীর আমন্ত্রণে অতুলবাবু, রণেনবাবু ও সুকান্তবাবু এলেন সেবারে কাশীতে। এবং বলাই বাহুল্য সুবালা সত্যি সত্যিই এবারে অতুলবাবুর প্রতি আকৃষ্ট হল। এবং সে আকর্ষণ ক্রমে বর্ধিত হয়ে চলল মণিকা দেবী অসুস্থ হয়ে পড়ায় ও তার সেবার মধ্য দিয়ে অতুলবাবুর কাছে আরও ঘনিষ্ঠ হয়ে এসে। সৌভাগ্যক্রমে এ সংবাদ আমার গোচরীভূত হয় তদন্তের দিন অতুলবাবুর সুটকেস হাতড়াতে গিয়ে, তাঁর সুটকেসের মধ্যে তাঁর স্বহস্তলিখিত রোজনামচাখানি পেয়ে ও পড়ে। অতুলবাবুও যে সুবালার রূপে প্রথম দিকে কিছুটা আকর্ষিত হননি তা নয়, কিন্তু তাঁর মণিকা দেবীর প্রতি একনিষ্ঠ প্রেম শিক্ষা ও রুচি তাঁর মনের ওপরে করাঘাত হেনে তাঁকে সজাগ করে দিল। তিনি সজাগ হয়ে সরে গেলেন।
রুদ্ধ নিশ্বাসে সকলে কিরীটীর কথা শুনছে। বোবা বিস্ময়ে সকলেই নির্বাক।
কিরীটী পকেট হতে সিগার-কেসটা বের করে একটা সিগারে অগ্নিসংযোগ করলে। জ্বলন্ত সিগারটায় গোটাকয়েক টান দিয়ে আবার তার বক্তব্য শুরু করল।
যা বলছিলাম, অতুলবাবুও সাবধান হলেন কিন্তু সুবালা তখন মরিয়া হয়ে উঠেছে। তার আর ফেরবার পথ ছিল না। এবং সোজাসুজি ভালবাসা বিকারে একদিন সুবালা অতুলবাবুর হাত চেপে ধরলে। অতুলবাবু জানালেন প্রত্যাখ্যান। প্রত্যাখ্যানের লজ্জা ও অপমান নিয়ে সুবালা ফিরে এল আর সেই লজ্জা ও অপমানের ভিতর হতে জন্ম নিল এক ভয়ঙ্কর কুটিল প্রতিহিংসা, পদাহতা নারী সর্পিণীর মত ছোবল তুলল। এই প্রতিহিংসা-অনলে ইন্ধন যোগায় দুটি বস্তু—এক অতুলের প্রত্যাখ্যান আর দুই মণিকা দেবীর চাইতে ঢের বেশী রূপবতী হয়েও অতুলকে আকর্ষণ না করতে পারায় মণিকা দেবীর কাছে তার পরাজয়।
প্রতিহিংসার ঐ আগুন তিন বৎসর ধরে সুবালা বুকের মধ্যে পুষে রেখেছে সুযোগের প্রতীক্ষ্ণয়। সেই সুযোগ এল এবারে যখন আবার আপনারা সকলে কাশীতে এলেন। এবং খুব সম্ভবত হয়ত অতুলবাবুর প্রতি প্রতিহিংসা নেবার জন্য সুবালা রণলালের শরণাপন্ন হয়। কারণ যেভাবে অতুলবাবুকে হত্যা করা হয়েছে সে পরিকল্পনা কোন নারীর মস্তিষ্ক-উদ্ভুত যে নয় এ ধারণা আমার প্রথম দিনই হয়েছিল। তাই প্রথম দিনই সন্দেহের তালিকা থেকে মণিকাদেবীকে আমি বাদ দিয়েছিলাম। যাহোক তারপর রণলালের আবির্ভাব ঘটল রঙ্গভূমে। এবং রণলালেরই পরামর্শমত, অবশ্য সবই আমার অনুমান, সুবালা কোন কিছুর সাহায্যে অতুলবাবুর ঘরের আলোটা নষ্ট করে মিস্ত্রীবেশী রণলালের প্রবেশের সুযোগ করে দেয় ওদের বাড়িতে। সুযোগমত মিস্ত্রীরূপী রণলাল রঙ্গভূমে প্রবেশ করে সবার অলক্ষ্যে মৃত্যু-ফাঁদ পেতে রেখে গেল।