কিরীটীর শেষের কথাগুলো যেন ঝমঝম্ করে ঘরের মধ্যে একটা বজ্রের হুঙ্কার ছড়িয়ে গেল।
সকলেই স্তব্ধ। নির্বাক। কারও মুখে একটি শব্দ পর্যন্ত নেই।
সহসা সুকান্ত চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় এবং ঘরের খোলা দরজার দিকে পা বাড়ায়। কিরীটীর কঠিন কণ্ঠ শোনা গেল, ঘর ছেড়ে যাবেন না সুকান্তবাবু! বসুন!
তীক্ষ্ণ ঝাঁঝালো কণ্ঠে সুকান্ত চেঁচিয়ে ওঠে, No, No! This is simply inhuman torture!I cant stand it any more!I cant!
না, আপনার এখন যাওয়া হতে পারে না। এগিয়ে আসে এবারে শিউশরণ।
শিউশরণকে দুহাতে পাগলের মতই ঠেলে ঘর হতে বেরিয়ে যাবার চেষ্টা করে চিৎকার করে প্রতিবাদ জানায় সুকান্ত, Let me go! Let me go! যেতে দিন, আমাকে যেতে দিন!
এবারে এগিয়ে এল রণেন, না, না। দাঁড়াও সুকান্ত। যদি আমাদের তিনজনের মধ্যেই একজন সত্যিই অতুলের হত্যাকারী হই—let that be decided once for all!
খিঁচিয়ে ওঠে সুকান্ত, decide করবে? কি decide করবে শুনি যে আমরাই একজন অতুলকে বন্ধু হয়ে হত্যা করেছি? ছিঃ ছিঃ! এর চেয়ে গলায় দড়ি দাও তোমরা।
এবারে মণিকা বলে, সুকান্ত, রণেন,তোমরা কি পাগল হলে?
সহসা রণেন ঘুরে দাঁড়ায় মণিকার কথায় তার দিকে এবং তীক্ষ্ণ ব্যঙ্গভরা কণ্ঠে বলে, খেপবার আরও কি কিছু বাকি আছে মণিকা! তবু যদি সে রাত্রে তোমাকে আমি সকলে শুতে যাবার পর অতুলের ঘর থেকে আমার ও তার ঘরের মধ্যবর্তী দরজা দিয়ে দ্রুতপদে বের হয়ে তোমার শোবার ঘরে যেতে না দেখতাম!
কি বলছো তুমি রণেন! বিস্ময়ে যেন চেঁচিয়ে ওঠে মণিকা।
হ্যাঁ হ্যাঁ, ঠিকই বলছি। অন্ধকার ঘর দেখে ভেবেছিলে তখনও বুঝি আমি ঘরে ঢুকিনি! তখনও বুঝি আমি বাথরুম থেকে ফিরিনি। কিন্তু সব—সব আমি দেখেছি। তুমি আমার চোখের সামনে দিয়ে ঘরের এক মাঝের দরজা দিয়ে অতুলের ঘর থেকে বের হয়ে অন্য মাঝের দরজা দিয়ে নিজের ঘরে চলে গিয়েছিলে। দেখেছি, আমি সব দেখেছি।
রণেন! রণেন,এসব তুমি কি বলছ! আমি তোমরা—তুমি ও অতুল ঘর ছেড়ে চলে আসবার পর প্রায় আধঘণ্টা সুকান্তর ঘরে দাঁড়িয়েই গল্প করেছি।
হ্যাঁ, she is right! সমর্থন করে সুকান্ত।
শাক দিয়ে মাছ ঢাকবার চেষ্টা করা আর বৃথা সুকান্ত। তীক্ষ্ণ কন্ঠে বলে ওঠে রণেন।
না, মিথ্যে নয়। যা বলেছি তা সত্যি। মণিকা আবার বলে।
থাক থাক, যথেষ্ট হয়েছে। ঘৃণাভরে মুখ ফেরায় রণেন।
এতক্ষণে কিরীটী কথা বলল, না রণেনবাবু, মণিকা দেবী, সুকান্তবাবু ও আপনি কেউই আপনারা মিথ্যে কথা বলেননি। কিন্তু এ কথাগুলো সে দিন জবানবন্দির সময় প্রত্যেকে আপনারা যদি গোপন না করতেন তবে এত কষ্ট করতে হত না আমাকে হত্যাকারীকে ধরতে। কথাটা বলে কিরীটী এবং শিউশরণের মুখের দিকে তাকাল এবং নিঃশব্দে চোখে চোখে কি যেন ইঙ্গিত জানাল এবং শিউশরণ নিঃশব্দে ঘর হতে বের হয়ে গেল।
এবারে সুবালা দেবী, এঁরা সকলেই যেটুকু যা গোপন করেছিলেন বললেন। আপনিও যা গোপন রেখেছেন বলুন! কিরীটী কথাগুলো বললে সুবালা দেবীর মুখের দিকে তাকিয়ে।
আমি যা জানতাম সব বলেছি। শান্ত ধীর কণ্ঠস্বর।
না, বলেননি। আপনি এখনও বলেন নি কেন আপনি সে রাত্রে অতুলবাবুর ঘরে গিয়ে তাঁর জন্য অপেক্ষা করছিলেন!
মিথ্যে কথা। তার ঘরে আদৌ আমি যাই নি সে রাত্রে।
কিন্তু সাক্ষী যে আছে সুবালা দেবী!
ঠিক এই সময় শিউশরণের সঙ্গে রণলাল চৌধুরী এসে সেই ঘরে প্রবেশ করল, এসবের মানে কি দারোগাবাবু! সেই সন্ধ্যা থেকে থানায় এনে আমাকে আটকে রেখেছেন! ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বললে রণলাল। তার কণ্ঠে রীতিমত বিরক্তি।
কি করি বলুন রণলালবাবু! সে রাত্রে যদি সত্যি কথাটা বলতেন তবে মিথ্যে কষ্ট দিতে হত না আপনাকে। জবাব দেয় কিরীটী।
তার মানে? এসব কি আপনি বলছেন?
ঠিকই বলছি। সুবালা দেবী স্বীকার যাচ্ছেন না যে সে রাত্রে সুবালা দেবী অতুলবাবুর ঘরে বসে অন্ধকারে তাঁর জন্য অপেক্ষা করছিলেন। কিন্তু আপনি তো সব দেখেছেন। Eye witness! আপনিই বলুন না?
কিরীটীর কথায় রণলাল ও সুবালা পরস্পর পরস্পরের মুখের দিকে তাকায়। তাকিয়ে থাকে তারা কিছুক্ষণ পরস্পর পরস্পরের প্রতি নিষ্পলক স্থির দৃষ্টিতে।
ঘরের মধ্যে উপস্থিত অন্যান্য সকলে যেন পাথরে পরিণত হয়েছে। সকলেই নির্বাক। বিমূঢ়।
এসবের মানে কি কিরীটীবাবু? শান্ত দৃঢ় কণ্ঠে প্রশ্ন করে সুবালা।
এখনও বুঝতে পারছেন না? আশ্চর্য! সুবালা দেবী, আপনি একজন পাকা অভিনেত্রী সন্দেহ নেই, কিন্তু দুর্ভাগ্য আপনার, ধর্মের কল বাতাসেই নড়েছে। এত করেও আপনি সব দিক বজায় রাখতে পারেননি।
কিরীটীবাবু? তীক্ষ্ণ চিৎকার করে ওঠে মণিকা।
হ্যাঁ মণিকা দেবী, অতুলের হত্যাকারিণী উনিই। সুবালা দেবী। অবশ্য পরিকল্পনাটি ওঁর নয়, ওনার। রণলালবাবুর। এই দুই প্রেমিক-প্রেমিকারই যুগ্ম প্রচেষ্টায় অতুলবাবু নিহত হয়েছেন।
বলেন কি! প্রশ্নটা সকলেই প্রায় একসঙ্গে করে।
মৃতু-ফাঁদ পেতেছিলেন রণলাল তাঁরইপ্রেমিকা সুবালার অনুরোধে। তারপর সেই মৃত্যুফাঁদকে সক্রিয় করে তোলেন উনি শ্রীমতী সুবালা দেবী। কিরীটী জবাব দেয়।
হঠাৎ ঐ সময় পাগলের মত চীৎকার করে ওঠে রণলাল সুবলার দিকে তাকিয়ে, হারামজাদী! তবে তুই সব বলেছিস? তোকে আমি খুন করব!