কিরীটীর কথাগুলো যেন রণেন, সুকান্ত ও মণির কর্ণকুহরে গলিত সীসের মতই প্রবেশ করল।
তিনজনেই ওরা পরস্পর পরস্পরের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে নির্বাক। কিরীটী কিন্তু ওদের কারোর দিকেই তাকাচ্ছে না। ওদের যেন সম্পূর্ণ অবজ্ঞা করে একটা সিগারে অগ্নিসংযোগে ব্যস্ত।
সমস্ত ঘরটার মধ্যে যেন একটা শ্বাসরোধকারী আবহাওয়া জমাট বেঁধে উঠেছে। সিগারেটটায় অগ্নিসংযোগ করে তাতে গোটা দুই টান দিয়ে হঠাৎ কিরীটীই নিজের রচিত শ্বাসরোধকারী ঘরের মৃত্যুশীতল স্তব্ধতাটা ভেঙে দিল, অতুলবাবুর হত্যার পশ্চাতে আছে একটা দীর্ঘদিন ধরে লালিত হিংসা। দিনের পর দিন দীর্ঘ কয়েক বৎসর ধরে তিনটি পুরুষের মনের অবগহনে একটি নারীকে কেন্দ্র করে চলেছিল এক হিংসার কুটিল ভয়ঙ্কর বিষমন্থন। শুনে আশ্চর্য হবেন না আপনারা কেউ, অতুলবাবু নিহত না হয়ে রণেনবাবু ও সুকান্তবাবু আপনাদের দুজনের একজন নিহত হতে পারতেন। এবং অতুলবাবু নিহত না হয়ে আপনাদের মধ্যে একজন কেউ নিহত হলে, অতুলবাবু ও অন্য একজনকে হয়ত আজকের এই কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হত। আজকের এই পরিস্থিতি অনিবার্য হয়ে উঠেছিল। হ্যাঁ, প্রত্যেকেই আপনারা তিন বন্ধু আপনাদের ঐ বান্ধবীর জন্য পরস্পরের প্রতি দিনের পর দিন দীর্ঘকাল ধরে নিরতিশয় ঘৃণা ও হিংসা পোষণ করেছেন। হয়ত বা মনে মনে কত সময় পরস্পর পরস্পরকে হত্যা করবার সঙ্কল্পও করেছেন। কিন্তু হত্যার সঙ্কল্প করলেই কিছু হত্যা করা যায় না। তার জন্য চাই ক্ষণিক একটা বিকৃত উন্মাদনা, ভয়ঙ্কর একটা প্রতিজ্ঞা। এ তো হঠাৎ হত্যা করা নয়। এ যে স্থির মস্তিষ্কে দৃঢ় সংকল্প নিয়ে হত্যায় লিপ্ত হওয়া। ভাবুন তো একবার বাইরে বন্ধুত্বের মুখোশ এঁটে মনের মধ্যে সন্তর্পণে হত্যার জন্য ছুরি শানিয়েছেন। দিনের পর দিন মনের মধ্যে পরস্পর পরস্পরের প্রতি প্রচণ্ড হিংসা ও ঘৃণা পোষণ করে বাইরে ভালবাসা ও প্রেমের চটকদার অভিনয় করেছেন। এবং আজ রাত্রে অহল্যাবাঈ ঘাটে যে ঘটনাটা ঘটে গেল সেটা দীর্ঘদিনের ঐ গোপনে মনের মধ্যে লালিত পরস্পরের প্রতি পরস্পরের প্রচণ্ড হিংসা ও ঘৃণা ঐ মণিকা দেবীকে কেন্দ্র করে।
কিরীটী কথাগুলো বলে ক্ষণকালের জন্য চুপ করে থাকে।
হঠাৎ রণেনবাবুর কণ্ঠস্বর শোনা গেল, উঃ,ঘরের মধ্যে বিশ্রী গরম! জানলাগুলো একটু খুলে দিতে বলুন না। দম বন্ধ হয়ে আসছে।
ঘরের তিনটে জানলার মধ্যে দুটো জানলার কবাটগুলো খোলাই ছিল, বাকি জানলার পাল্লা দুটোও এগিয়ে গিয়ে কিরীটী হাত দিয়ে ঠেলে খুলে দিল।
ঘরের দেওয়ালে টাঙানো কটায় ঢং ঢং করে রাত তিনটে ঘোষণা করল। ইতি মধ্যেই রাত্রিশেষের প্রহরগুলিতে শিশিরের একটা সিক্ততা দেখা দিয়েছে। একটা আর্দ্র ঠাণ্ডা-ঠাণ্ডা ভাব।
নিস্তব্ধ সকলে একে অন্য হতে অল্প অল্প ব্যবধানে বসে আছে ঘরের মধ্যে। তিনটি ফাঁসির আসামী যেন রাত পোহালে ফাঁসি হবে তারই অধীর ব্যাকুল প্রতীক্ষ্ণয় প্রহর গুনছে। মুখের দিকে তাকালে মনে হয় তিনটি প্রাণহীন পুতুল যেন।
কিরীটীর কঠিন নিষ্ঠুর কণ্ঠস্বর আবার শোনা গেল, শুধু আপনারাই ঐ দোষে দোষী নন রণেনবাবু, সুকান্তবাবু। সর্বত্র চলেছে আজ ঐ হিংসার কুটিল আবর্ত। যুগ যুগ ধরে মানুষের শুভবুদ্ধির ও ভালবাসার দুশ্চর তপস্যা ব্যর্থ হয়েছে। হিংসা! হিংসা: হিংসা সর্বত্র! বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন ভাবে প্রকাশ পাচ্ছে। কিন্তু যাক সে কথা। এবারে অতুলবাবুর হত্যার ব্যাপারে ফিরে আসি।
শিউশরণ এখানে বাধা দেয়, কিন্তু–
কিরীটী মৃদু হেসে বলে, বুঝেছি তোমার খটকা কোথায় লাগছে শিউশরণ! ইলেকট্রিক মিস্ত্রী আর কেউ নয় হত্যাকারীই স্বয়ং সকলের চোখে ধুলো দেবার জন্য ঐ বেশ নিয়েছিল।
তারপর একটু থেমে যেন দম নিয়ে তার অসমাপ্ত বক্তব্যে ফিরে আসে, আমার মনেও ঐখানেই খা লেগেছিল। এবং সেইজন্যই আসলে ছোট একটা একসপেরিমেন্টের আয়োজন করেছিলাম আজ রাত্রে আমি গঙ্গার ঘাটে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত তাতে করে অতুলবাবুর নৃশংস হত্যারহস্যের জটিল অংশের দুইয়ের তিন অংশ পরিস্কার হয়ে গেলেও বাকি ও শেষ অংশটুকু এখনও অস্পষ্টই আছে। এবং সেইজন্যই গঙ্গারঘাট হতে সকলকে নিয়ে আমি এখানে এসে মিলিত হয়েছি। তারপর হঠাৎ শিউশরণের মুখের দিকে তাকিয়ে কিরীটী বললে, বাইরে এইমাত্র পদশব্দ পেলাম। দেখ উনিও বোধ হয় এসে গেলেন। তাঁকেও এই ঘরে নিয়ে এস, যাও।
বিস্মিত নির্বাক সকলের সামনে দিয়েই শিউশরণ ঘর হতে বের হয়ে গেল এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই সুবালা দেবীকে নিয়ে ঐ ঘরের মধ্যে এসে প্রবেশ করল।
যুগপৎ ঘরের মধ্যে ঐ সময় উপস্থিত সকলেই নির্বাক বিস্ময়ে সুবালা দেবীর দিকে তাকাল নীরব দৃষ্টি তুলে। শিউশরণ তার চেয়ারটাই এগিয়ে দিল সুবালাদেবীর দিকে, বসুন।
কেবল মণিকার কঠ হতে উচ্চারিত হল একটিমাত্র শব্দ, সুবালাদি!
বসুন সুবালা দেবী। কিরীটী বললে।
নিঃশব্দে সুবালা দেবী শিউশরণের খালি চেয়ারটায় উপবেশন করে।
মণিকা দেবী, সুবালা দেবী, রণেনবাবু, সুকান্তবাবু আপনারা সকলেই উপস্থিত এখানে সে রাত্রে যাঁরা ঘটনাস্থলের আশেপাশে ছিলেন। একটা কথা না বলে পারছি না, সকলেই আপনারা সেদিনকার আপনাদের প্রদত্ত জবানবন্দিতে কিছু কিছু গোপন করেছেন। একান্ত পৈশাচিক ভাবেই সে রাত্রে আপনাদেরই চারজনের মধ্যে একজন অতুলবাবুকে হত্যা করেছেন। এবং এও আমি জানি আপনাদেরই মধ্যে কে তাঁকে হত্যা করেছেন। তাই আবার আজ এখন শেষ অনুরোধ আপনাদের জানাচ্ছি, এখনও আপনারা যে যা গোপন করেছেন খুলে বলুন। অকাট্য প্রমাণ দিয়ে আমায় সাহায্য করুন হত্যাকারীকে ধরিয়ে দেবার।