আমি।
ও, তুমি! এস, বস। নারী আহ্বান জানাল।
কিন্তু কি ব্যাপার বল তো! এভাবে এই জায়গায় চিঠি দিয়ে দেখা করবার জন্য ডেকে আনবার মানে কি? যা বলবার আমার ঘরে রাত্রে এসেও তো বলতে পারতে। পুরুষ বলে।
না। বলতে পারতাম না তার কারণ কারও না কারও নজরে পড়ে গেলে পরের দিন সকালে তুমি বা আমি কেউই কি আর মুখ দেখাতে পারতাম! আর যাই করি এত বড় নির্লজ্জ অন্তত দিদিমার সামনে হতে পারতাম না।
কিন্তু এখনও আমি বুঝতে পারছি না, মণি, এভাবে এত রাত্রে এ জায়গায় কেন তুমি ডেকে এনেছ আমাকে!
কেন ডেকে এনেছি জান? অতুলের মৃত্যুর ব্যাপারটা একবার ভোলাখুলি তোমার সঙ্গে আলোচনা করতে চাই।
আশ্চর্য! সে আলোচনার জন্য এইভাবে এত রাত্রে চিঠি লিখে গঙ্গার ঘাটে ডেকে আনবার কোন প্রয়োজনই তো ছিল না মণি।
ছিল।
কেন?
কারণ লোক-নিন্দা ও লোকেদের কথা ছেড়ে দিলেও একটা কথা আমাদের তিনজনের একজনও কি অস্বীকার করতে পারব যে, আমাদের তিনজনের মধ্যেই একজন অতুলের এই নিষ্ঠুর হত্যার জন্য দায়ী?
সত্যিই কি তুমি তাই মনে কর মণি?
কিরীটীবাবু মনে করেন। গতকাল তাই তিনি আমাকে থানায় ডেকে পাঠিয়েছিলেন।
মিঃ কিরীটী রায় আর কি মনে করেন? নিশ্চয়ই আমাদের তিনজনের মধ্যে যে হত্যাকারী তাকেও তিনি তাঁর অপূর্ব বুদ্ধির প্যাঁচে ফেলে সনাক্ত করে ফেলেছেন! বলেই ফেল না! সে কথাটাই বা লুকোচ্ছ কেন? আমাদের তিনজনের মধ্যে কে? তুমি, আমি, না রণেন?
পুরুষ আর কেউ নয়, সুকান্ত। এবং নারী মণিকা।
সুস্পষ্ট ব্যঙ্গে সুকান্তর কণ্ঠস্বর এবারে আরও কঠিন মনে হয়, কিন্তু সেই কারণে এমনি করে এই রাত্রে গঙ্গার ঘাটে টেনে এনে এ নাটক সৃষ্টি না করলেও পারতে মণি। এবারে তোমাকে আমি সত্যিই বলছি, এই তেলাপোকা আর কাঁচপোকার নাটক এখানেই আমি শেষ করতে চাই। আমার কি ইচ্ছে হচ্ছে জান? একজন তো গেছেই, বাকি দুজনকেও শেষ করে অবশেষে নিজেকে হত্যা করে এই নবৎসরের নাটকের ওপর যবনিকা টেনে দিই। আসলে তুমি কি জান মণিকা! একটি harlot!
সুকান্ত!
চেঁচিয়ে কোন লাভ নেই মণিকা। এখন দেখতে পাচ্ছি চিঠি দিয়ে আজ রাত্রে এখানে তুমি আমাকে ডেকে এনে একপক্ষে ভালই করেছ। আমাদের চারজনের এই নাটকের শেষ দৃশ্যটুকু তোমাকে ভাল করেই বুঝিয়ে দিয়ে যেতে পারব। অপূর্ব এক ভালবাসার অভিনয় তুমি এই দীর্ঘ নবৎসর ধরে করছ। সত্যিই তুমি অনন্যা!
সুকান্ত! আর্ত করুণ কণ্ঠে যেন চিৎকার করে ওঠে মণিকা।
থাম। শোন, মনে পড়ে তোমার দার্জিলিংয়ের সে রাত্রের কথা! সে রাত্রের ঘটনার জন্য পরে আমি অনুতপ্ত হয়েছিলাম এই ভেবে যে, হয়ত আমাদের তিনজনের মধ্যে আমাকে বাদ দিয়ে অতুল বা রণেনকে তুমি মনে মনে ভালবাস, কিন্তু তুমি অগ্রসর হতে পারছ না আমাদের তিনজনের বন্ধুত্বের কথা ভেবেই। পাছে আমাদের দুজনের মনে আঘাত লাগে একজনকে তুমি বরণ করলে। পরে বুঝেছিলাম ভুল আমারই। ভালবাসা তোমার চরিত্রে নেই। ভালবাসতে তুমি কাউকেই কোনোদিন পারবে না। ভালবাসতে হলে যে মনের দরকার, যে কোমল অনুভূতির প্রয়োজন সেইখানেই ঝুলি তোমার শূন্য। সেইখানেই তোমার চরিত্রের পরম দৈন্য। যে নারীর মনে ভালবাসার অনুভূতি নেই অথচ রূপ ও যৌবন আছে, সে বিকৃত মনেরই সমগোত্রীয়। তাই তোমার সংসর্গে যা অবশ্যম্ভাবী তাই ঘটেছে, অতুল নিহত হয়েছে। এবার হয়ত আমাদের পালা কিন্তু অতদূর আমি গড়াতে দেব না।
সুকান্তর কণ্ঠস্বর উত্তেজনায় যেন কেঁপে কেঁপে উঠছে।
সভয়ে আবার চিৎকার করে ওঠে মণিকা ভয়ার্ত ব্যাকুল কণ্ঠে, সুকান্ত! সু—
হাঃ হাঃ করে বজ্রকণ্ঠে হেসে ওঠে সুকান্ত। হাসির শব্দটা একটা প্রতিধ্বনি তুলে নির্জন অহল্যাবাঈ ঘাট হতে নিশীথের গঙ্গাবক্ষের উপর দিয়ে রাতের অন্ধকারে ছড়িয়ে পড়ে।
হ্যাঁ, নির্জন এই অহল্যাবাঈ ঘাটে গঙ্গার উপকূলে কেউ নেই। তোমাকে গলা টিপে হত্যা করে অন্ধকারে ঐ গঙ্গার জলে ভাসিয়ে দিয়ে যাব। হাঃ হাঃ! আবার পাগলের মত অট্টহাসি হেসে ওঠে সুকান্ত। এগিয়ে গিয়ে সুকান্ত মণিকার ডান হাতের সুকুমার মণিবন্ধটা চেপে ধরে লৌহ-কঠিন মুষ্ঠিতে।
সুকান্ত! সুকান্ত—আমি-মণিকা ব্যাকুল কণ্ঠে কি যেন বলবার চেষ্টা করে।
কেই শুনতে পাবে না। কেই জানতে পারবে না—দুহাতে মণিকার গলাটা টিপে ধরে সুকান্ত।
ঠিক এমনি সময় ঘাটের কাছে অন্ধকারে যে নৌকো দুটো বাঁধা ছিল তার একটার মধ্যে একটা ঝটাপটির শব্দ শোনা যায় এবং পরক্ষণেই কে একজন ব্যাঘ্রের মত ঘাটের ওপরে নৌকো থেকে লাফিয়ে পড়ে সুকান্তকে আক্রমণ করে।
সুকান্ত, ছাড়। ছাড়—খুনী শয়তান–
সঙ্গে সঙ্গে প্রায় নৌকোর ভেতর থেকে কিরীটী, শিউশরণ ও সুব্রত ঘাটের সিঁড়ির উপর লাফিয়ে পড়ল। রণেনের আক্রমণ থেকে সুকান্তকে মুক্ত করে দেয় কিরীটী।
সুকান্ত ও রণেন দুজনেই তখন হাঁফাচ্ছে।
রণেন কিন্তু চেঁচিয়ে বলে, না না ওকে ছাড়বেন না মিঃ রায়। সুকান্ত–সুকান্তই অতুলকে হত্যা করেছে।
.
আরও আধ ঘণ্টা পরে রণেন, সুকান্ত ও মণিকাকে নিয়ে কিরীটী ও শিউশরণ থানায় গিয়ে হাজির হল। থানার অফিসঘরে সকলে প্রবেশ করে এবং কিরীটী সকলকে বসতে অনুরোধ করে।
আরও কিছুক্ষণ পরে কিরীটী বলতে শুরু করে, আজ রাত্রে কিছুক্ষণ আগে অহল্যাবাঈ ঘাটে যে ঘটনাটা ঘটে গেল সে জন্যে আমি বিশেষ দুঃখিত এবং আপনাদের তিনজনের কাছেই সেজন্যে আমি ক্ষমাপ্রার্থনা করছি। অতুলবাবুর মৃত্যুরহস্যের উদঘাটনে পৌঁছবার জন্য আমি ছোট্ট একটা একত্সপেরিমেন্ট করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু সে একত্সপেরিমেন্টের সমাপ্তিটা যে এমন বিশ্রী তিক্ত ব্যাপারে গিয়ে দাঁড়াবে সত্যি আমি তা ভাবিনি। আপনারা তিনজনেই বিশ্বাস করুন আজকের ক্ষণপূর্বে অহল্যাবাঈ ঘাটে যে একসপেরিমেন্টের পরিকল্পনা আমি করে মণিকা দেবীকে দিয়ে সুকান্তবাবুকে রাত্রে গঙ্গার ঘাটে দেখা করবার জন্য চিঠি দিইয়ে এবং নৌকো ভাড়া করে সেই নৌকার মধ্যে অন্ধকারে রণেনবাবুকে নিয়ে আত্মগোপন করেছিলাম, সবটাই এই সৎ উদ্দেশ্যেই করেছিলাম যে আজকের এই ছোট্ট একসপেরিমেন্টের ভেতর দিয়েই আমরা অতুলবাবুর হত্যারহস্যের একটা মীমাংসায় পৌছাব এবং হত্যাকারীকে সনাক্ত করতে পারব। যদিও হত্যাকারী কে আমরা বুঝতে পেরেছি তাহলেও কিছুক্ষণ পূর্বে গঙ্গার ঘাটে আপনাদের তিনজনকে কেন্দ্র করে যে অপ্রীতিকর ঘটনাটা ঘটে গেল সেটা এখন বুঝতে পারছি অবশ্যম্ভাবীই হয়ে উঠেছিল। এবং ঐ অপ্রীতিকর ব্যাপারটা আজ রাত্রে গঙ্গার ঘাটে না ঘটলেও দু-এক দিনের মধ্যেই যে ঘটত সে বিষয়ে এখন আমি সম্পূর্ণ নিঃসন্দেহ।