আচ্ছা আমরা তাহলে চলি রণলাল। আপনার সঙ্গে পরিচয় হয়ে ভারী আনন্দ হল। আর এভাবে হঠাৎ এসে অসময়ে আপনাকে বিরক্ত করে গেলাম বলে মনে কিছু করবেন না। কিরীটী বিনয়ে যেন বিগলিত হয়ে যায়।
না না বরং আপনাদের সঙ্গেও তো আমার আলাপ হল। অবশ্য আপনারা না এলে আমিই হয়ত যেতাম। কিন্তু জানেন তো, ঠিক সাহস পাইনি। হাজার হোক কেউ স্বেচ্ছায় কি পুলিসের সামনে যায়! বলে রণলাল নিজেই হেসে ওঠে।
রণলালের ওখান হতে বিদায় নিয়ে তিনজনে আবার খোদাইচৌকির দিকেই ফিরছিল।
হঠাৎ একসময় শিউশরণ প্রশ্ন করে, রণলালবাবু যে নীল আলোর কথা বললেন, ব্যাপারটা তোমার কি মনে হচ্ছে কিরীটী? Something electrical ব্যাপার নয় তো? তুমি তো বলছিলে এবং ময়না তদন্তেও প্রকাশ অতুল বোসকে electrocution করে হত্যা করা হয়েছে!
কিরীটী মৃদু কণ্ঠে বলে, হ্যাঁ। তাই কি?
একবার কাল সকালে মণিকা দেবীদের বাড়িতে অতুল বোস যে ঘরে থাকত সেই ঘরের ইলেকট্রিক কানেকশনটা দেখে এলে হত না?
শিউশরণের কথায় কিরীটীর ওষ্ঠপ্রান্তে মৃদু একটা হাসির বঙ্কিম রেখা জেগে ওঠে।
অতুল বোসের মৃত্যু-তদন্তের ব্যাপারে যদিও সুব্রত প্রথম হতেই উপস্থিত এবং তৎসংক্রান্ত সকল প্রকার আলোচনাই সে শুনেছে, সে কিন্তু একটি কথাও বলেনি।এবারের হত্যা-তদন্তে সে যেন এক নীরব দ্রষ্টা ও শ্রোতা মাত্র। তবে মুখে কোনরূপ প্রশ্ন বা মন্তব্য না করলেও মনে মনে সে সমগ্র ব্যাপারটাই নিজের বুদ্ধি ও বিবেচনায় বিচার বিশ্লেষণে একটা মীমাংসায় পৌঁছবার চেষ্টা শুরু হতেই করে আসছিল।
হঠাৎ একটা কথা সুব্রতর মনে পড়ে। পরশু সকালে মণিকা দেবীদের গৃহ হতে ফেরবার পথে কথাপ্রসঙ্গে কিরীটী বলেছিল: হাই ভোলটের কারেন্টে বেচারার মৃত্যু হয়েছে। প্রমাণের খানিকটা অংশ সরিয়ে ফেললেও হত্যাকারী আমার চোখে ধুলো দিতে পারেনি। কারণ ষড়যন্ত্রের পরিকল্পনার কিছুটা মালমসলা তখনও ঐ ঘরে অবশিষ্ট ছিল। কিন্তু কি সে প্রমাণ! এখন সহসা একটা সম্ভবনা বিদ্যুৎ-চমকের মতই সুব্রতর মনে ভেসে ওঠে: অতুল বোসের মৃতদেহটা চেয়ারের উপরে উপবিষ্ট ছিল। চেয়ারটি স্টীলের পাত ও রডে তৈরী। ইলেকট্রিক কারেন্টে মৃত্যু। তবে কি ঐ স্টীলের চেয়ারটাই!
কিরীটীর কণ্ঠস্বর শোনা গেল। না শিউশরণ, তার আর প্রয়োজন নেই। বললাম তো, হত্যাকারী তার নিদর্শন স্বরূপ যে প্রমাণটুকু হয় ইচ্ছা করে অপসারণের প্রয়োজন মনে করেনি অথবা নিয়তিরই নিষ্ঠুর ইঙ্গিতে তাকে আকর্ষণ করেনি বলেই ফেলে রেখে গিয়েছে, সেইখানেই সে ধরা পড়ে গিয়েছে।
কি সে প্রমাণ? কথাটা শিউশরণ না জিজ্ঞাসা করে থাকতে পারে না।
একটা তামার পাতের রিং মত যেটা অতুল বোসের মৃতদেহ যে চেয়ারের ওপরে উপবিষ্ট ছিল তার পায়ার সঙ্গে লাগানো ছিল। মৃদু কণ্ঠে কথাটা উচ্চারণ করে কিরীটী সহসা যেন প্রসঙ্গান্তরে চলে গেল। কিন্তু যাক সে কথা। আমি ভাবছি হত্যাকারীর দুঃসাহসিক বুকের পাটার কথা। এত বড় দুঃসাহস হল কি করে! একপক্ষে অবিশ্যি ভালই হয়েছে, একটা জায়গায় এসে আমি হোঁচট খাচ্ছিলাম বার বার। ঠিক রাত কটায় অতুলকে হত্যা করা হয়েছে! এখন বুঝতে পারছি রাত সাড়ে এগারোটা থেকে রাত পৌনে বারোটার মধ্যেই।
বলতে বলতে সহসা শিউশরণের মুখের দিকে তাকিয়ে কিরীটী বলে, বুঝলে শিউশরণ, এ হত্যার পরিকল্পনা একদিনের বা হঠাৎ কোন এক বিশেষ মুহূর্তের আকস্মিক নয়। অত্যন্ত ঠাণ্ডা মস্তিষ্কে স্থিরীকৃত। কিন্তু তার পশ্চাতে আছে হয়ত কোন বিচিত্র অনুভূতির গোপন পীড়ন যেটা দীর্ঘদিন ধরে তিলে তিলে হত্যাকারীর মনের অবগহনে তার হত্যার মতই একটা পাশবিক জিঘাংসা বা লিন্সাকে জাগিয়ে তুলেছে। সঙ্কল্প হয়েই ছিল শুধু মাত্র সুযোগের ও স্থানের অপেক্ষা, সেই সুযোগ ও স্থান মিলে গেল এবারে পূজাবকাশের ছুটিতে কাশীতে। হত্যাকারীর মনের মধ্যে যে বিচিত্র সঙ্কল্পটা বিষের ধোঁয়ার মতই ধোঁয়াচ্ছিল, যেটা ছিল কিছুটা স্পষ্ট, কিছুটা অস্পষ্ট, বিচিত্র অনুকূল পরিবেশে সেটা অকস্মাৎ হয়তো কোন কারণে নখদন্ত বিস্তার করে আত্মবিকাশ করেছে। এবং আমার অনুমান যদি সত্য হয় তাহলে বোধ হয় হত্যা করবার জন্য যে পরিকল্পনাটুকু হত্যাকারী করেছে সেটা পূর্বপরিকল্পিত নয়, হঠাৎই হয়ত তার মনে সম্ভাবনাটুকু উদয় হওয়ায় কাজে লাগাবার চেষ্টা করেছে পরিকল্পনাটা। And it became successful! হতভাগ্য অতুল বোসের মৃত্যু ছিল ঐরূপ এক দুর্ঘটনাতেই, ঘটে গেল সেই দুর্ঘটনা। কথাগুলো একটানা বলে কিছুক্ষণ কিরীটী স্তন্ধ থাকে। তারপর আবার মৃদু কণ্ঠে বলে, একটি ছোট্ট এক্সপেরিমেন্ট করব। এবং আশা করি তারপরই এ রহস্যের ওপরে যবনিকা ভোলা যাবে।
.
দিন দুই পরে। অহল্যাবাঈ ঘাট, রাত্রি বোধ করি এগারোটা হবে। স্থানটি ঐ সময় একপ্রকার নির্জন বললেও হয়। চাঁদ উঠতে দেরি আছে। শুক্লপক্ষের মেঘমুক্ত আকাশে একরাশ তারা ঝিকমিক করে জ্বলছে। গঙ্গার জলে পড়েছে সেই আকাশের তারার স্তিমিত আলোর ক্ষীণ দীপ্তি।
ঘাটের কাছে পর পর দুটি নৌকো বাঁধা। অস্পষ্ট আলোছায়ায় সেই নৌকোর সামনে একটি নারীমূর্তি উপবিষ্ট দেখা যাচ্ছে।
পশ্চাতে পায়ের শব্দ পাওয়া গেল। দীর্ঘকায় কে একজন সিঁড়ি ভেঙে ঘাটের কাছে নেমে আসছে। একজন পুরুষ। পুরুষ নারীর পশ্চাতে এসে দাঁড়াল। অস্পষ্ট আলোছায়ায় তাকেও ভাল করে চেনা যায় না। নারীমূর্তি ফিরে তাকাল, কে?