মাঝারি আকারের ঘর। নীচু ছাত।
ঘরের মধ্যে আসবাবপত্রের তেমন কোন বাহুল্য না থাকলেও একটা ছিমছাম পরিচ্ছন্ন ভাব আছে।
ঘরের মধ্যস্থলে একটা তক্তপোশ পাতা। তার উপরে একটা শতরঞ্চ বিছানো। এবং খান-দুই চেয়ার।
দেওয়ালে একটি বাংলা-ইংরাজী দেওয়ালপঞ্জী ভিন্ন অন্য কোন ছবি নেই।
বসুন—ভদ্রলোকই আহ্বান জানালেন।
তক্তপোশের ওপরেই সকলে উপবেশন করে।
ঘরের আলোয় ভদ্রলোকের চেহারাটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। বলিষ্ঠ গঠন। চওড়া কপাল। পরিপাটি করে চুল আঁচড়ানো। মধ্যখানে সিঁথি, ঠোঁটের উপরে একজোড়া ভারী গোঁফ।
আপনার নামটা জিজ্ঞাসা করতে পারি কি? কিরীটীই প্রশ্ন করে।
রণলাল চৌধুরী।
দেখুন মিঃ চৌধুরী, এই সময় হঠাৎ এসে আপনার কাজের ব্যাঘাত ঘটিয়ে বিরক্ত করছি বলে আমরা বিশেষ দুঃখিত। অবশ্য বেশী সময় আপনার আমরা নষ্ট করব না। যে জন্যে এসেছি সেই কথাই বলি। আপনি শুনেছেন হয়ত আপনার বাড়ির সামনের বাড়িতেই পরশু এক ভদ্রলোক মারা গিয়েছেন।
শুনেছি।
আচ্ছা আপনাদের এই বাড়িতে উপরে নীচে কখানা ঘর মিঃ চৌধুরী?
ওপরে দুখানা-নীচে দুখানা।
আপনাদের family member কজন?
Family member বলতে আমরা দুজন। আমি আর আমার বুড়ো বাবা।
বাড়ির কাজকর্ম করার লোক নেই?
ঠিকে রাঁধুনী ও ঝি আছে। আর আমার দোকানের একটা বাচ্চা চাকর রাত্রে এখানে এই ঘরে থাকে।
ও। আপনার বুঝি দোকান আছে?
হ্যাঁ। চকে Electric goods-এর একটা দোকান আছে।
হুঁ। ওপরে আপনি কোন ঘরে থাকেন জানতে পারি কি?
রাস্তার ওপরের ঘরটাতেই থাকি।
আচ্ছা সাধারণত কত রাতে আপনি শুতে যান?
রাত বারোটা-একটার আগে বড় একটা আমি ঘুমোই না।
অত রাত পর্যন্ত জেগে থাকেন?
হ্যাঁ। বইটই পড়ি আর কি।
পরশু রাত্রে?
তা সাড়ে বারোটা পর্যন্ত প্রায় জেগে বই পড়েছি।
আপনার ঘরের জানলা খোলা ছিল- mean রাস্তার দিকের জানলাটা?
হ্যাঁ। জানলা-দরজা আমার ঘরের সব সময় ভোলাই থাকে।
মিঃ চৌধুরী, আপনি বলতে পারেন পরশু রাত্রে সাড়ে এগারোটা থেকে রাত বারোটার মধ্যে সামনের বাড়ির দোতলার ঠিক আপনার ঘর থেকে সামনের ঘরে কোন কিছু দেখেছেন বা শুনেছেন?
ভদ্রলোক একটু ইতস্তত করছেন বলে যেন মনে হয়।
কিরীটীর চোখের দৃষ্টি কিন্তু রণলাল চৌধুরীর ওপরেই নিবদ্ধ থাকে।
মিঃ চৌধুরী, যদি কিছু দেখে থাকেন বা শুনে থাকেন তো বলুন। কারণ আপনি হয়ত নিশ্চয়ই শুনেছেন মৃত্যুটা স্বাভাবিক নয়—কিরীটী বলে।
তার মানে! কি আপনি বলতে চান? মার্ডার? সুস্পষ্ট একটা আতঙ্ক রণলাল চৌধুরীর কণ্ঠস্বরে প্রকাশ পায়।
সত্যিই তাই।
হত্যা! খুন!
হ্যাঁ।
অতঃপর রণলাল চৌধুরী কিছুক্ষণ গুম হয়ে বসে থাকে।
ঘরের মধ্যে একটা স্তব্ধতার পীড়ন যেন চলেছে।
তাহলে আমি যতটুকু জানি বলাই উচিত। সে রাত্রে দোকান থেকে ফিরতে আমার অন্যান্য দিনের চাইতে একটু রাতই হয়েছিল। খাওয়া-দাওয়া সেরে ঘরে ঢুকতে রাত সাড়ে এগারোটা বেজে গিয়েছিল। ঘরে ঢুকে আলোটা জ্বালতে যাব হঠাৎ একটা তীব্র নীল আলোর ঝাপটায় যেন চোখ দুটো আমার ঝলসে গেল। হকচকিয়ে দাঁড়িয়ে গিয়েছিলাম কিছুক্ষণের জন্য। খেয়াল যখন হল আমার ঘরের খোলা জানালাপথে সামনের বাড়ির ঘরটা দেখলাম অন্ধকার। ব্যাপারটা যে কি ঘটল কিছুই বুঝতে পারলাম না।
শুধু একটা নীল আলোর ঝাপ্টা? আর কিছু দেখেননি বা শোনেননি?
না।
কিছুক্ষণ আবার স্তব্ধতা।
স্তব্ধতা ভঙ্গ করলে কিরীটীই, ঐ বাড়ির সঙ্গে আপনার জানাশোনা নেই?
হ্যাঁ। মণিকা দেবীর দিদিমার সঙ্গে পরিচয় আছে। আমিও তাঁকে দিদিমা বলেই ডাকি। এবং উনিও আমাকে যথেষ্ট স্নেহ করেন।
ও! কতদিন এ বাড়িতে আপনারা আছেন?
তা বছর দশেক তো হবেই।
সুবালা দেবীর সঙ্গে আপনার পরিচয় নেই?
কে? ঐ রাঁধুনী মেয়েটা? রণলালের কণ্ঠে একটা সুস্পষ্ট অবজ্ঞা ও তাচ্ছিল্য।
হ্যাঁ।
না মশাই। মেয়ে তো নয় একেবারে পুরুষের বাবা। বিশ্রী ক্যাটকেটে কথাবার্তা!
আচ্ছা রণলালবাবু, অবসর সময় আপনার কেমন করে কাটে?
এই বইটই পড়ে, না হয় ক্লাবে তাস খেলে কাটাই।
তাহলে বই পড়া আপনার অভ্যাস আছে?
অভ্যাস কি বলছেন! চার-চারটে লাইব্রেরীর মেম্বার আমি!
শরৎ চাটুয্যের বই আপনার কেমন লাগে?
কেমন লাগে বলছেন? শরৎবাবুর লেখার আমি একজন গোঁড়া ভক্ত।
চরিত্রহীন বইটা পড়েছেন?
নিশ্চয়ই। বার চার-পাঁচ পড়েছি। সোৎসাহে জবাব দেয় রণলাল।
চরিত্রহীন উপন্যাসে কিরণময়ী সত্যি কাকে ভালবাসত বলে আপনার মনে হয় রণলালবাবু? দিবাকরকে না উপীন্দ্রকে?
কিরণময়ী ভালবাসত উপীন্দ্রকেই। দিবাকরের মত একটা গর্দভকে কোন মেয়েমানুষ ভালবাসতে পারে নাকি?
সুব্রত নিবাক হয়েই রণলালের সঙ্গে কিরীটীর কথাবার্তা শুনছিল। কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছিল না সুব্রত, হঠাৎ কিরীটী রণলালের মত একজন সদ্যপরিচিত লোকের সঙ্গে শরৎ-সাহিত্য প্রসঙ্গ নিয়ে মেতে উঠল কেন! অথচ এও তো সে জানে এ ধরনের ঘরোয়া আললাচনা কখনও কিরীটী নিজের মনোমত ব্যক্তিবিশেষের সঙ্গে ছাড়া করে না। তার স্বভাববিরুদ্ধ।
আর শিউশরণ তো স্পষ্টই মনে মনে বিরক্ত হয়ে উঠছিল। এই জন্যই কি হঠাৎ কিরীটী এ সময় বাড়ি হতে বের হয়ে এল।
রণলাল চৌধুরীর সঙ্গেই যদি তার পরিচয় করবার প্রয়োজন ছিল তবে বললেই তো হত তাকে। থানা থেকেই লোক পাঠিয়ে কিরীটী এই লোকটাকে ডেকে নিয়ে যেতে পারত। সেজন্য এ সময়ে এতদূর ছুটে আসবার কি প্রয়োজন ছিল!