সংসারে তাঁর আপনার বলতে ছিল স্ত্রী সারদা ও একমাত্র নাতনী মণিকা। মণিকা কাশীশ্বর চৌধুরীর একমাত্র সন্তান কন্যা রেণুকারও একমাত্র সন্তান। বহু অর্থব্যয় করে মনোমত পাত্রে কন্যা রেণুর বিবাহ দিয়েছিলেন। কিন্তু মণিকার যখন মাত্র চার বৎসর বয়স তখন একটা রেল-অ্যাকসিডেন্টে জামাই ও মেয়ে একসঙ্গে মারা গেল। সেই হতে মণিকা দাদু ও দিদিমার স্নেহযত্নেই মানুষ।
কাশীশ্বরের ইচ্ছা ছিল সরকারের চাকরি হতে অবসর নেওয়ার পর জীবনের বাকী কটা দিন দেবাদিদেবের লীলাভূমি কাশীধামেই নিঝঞাটে কাটিয়ে দেবেন। কিন্তু মানুষ ভাবে এক হয় আর এক। পেনসন নেওয়ার মাত্র যখন মাস চার-পাঁচ বাকী হঠাৎ এমন সময় অকস্মাৎ একদিন দ্বিপ্রহরে কর্মস্থল হতে ফিরে করোনারী থ্রম্বোসিসে এক ঘণ্টার মধ্যেই মারা গেলেন কাশীশ্বর।
প্রথম ও একটিমাত্র আক্রমণেই সব শেষ হয়ে গেল। মণিকা সেবার আই.এ. পরীক্ষার জন্য কলকাতার হস্টেলে থেকে প্রস্তুত হচ্ছে। মণিকার দাদু তখন মীরাটে কার্যস্থলেই ছিলেন। সেখানেই ঘটল দুর্ঘটনা। তার পেয়ে কলকাতা থেকে মীরাটে মণিকা ছুটে গেল। এবং মীরাট থেকে সোজা এসে দিদিমাকে নিয়ে উঠল কাশীর বাড়িতে। বাড়িটা খালিই, তালা দেওয়া ছিল। ভাড়া দেওয়া হয়নি কখনও।
কটা দিন কাশীতে থেকে সাধ্যমত সব গোছগাছ করে দিয়ে মণিকা আসন্নবর্তী পরীক্ষার জন্য আবার ফিরে এল কলকাতায়।
বুড়ী দিদিমার একমাত্র বন্ধন মণিকা ম্যাট্রিক পাস দেওয়ার পর হতেই কলকাতার হস্টেলে সেই যে গিয়ে ডেরা বেঁধেছে—সেই যেন পাকাপোক্তভাবে তার দিদিমার আশ্রয়নীড় হতে হয়েছে বিচ্ছিন্ন। ক্রমে হস্টেল-জীবনেই সে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। একটি একান্তভাবে একেবারে নিজের ঘর বাঁধবার স্বপ্ন যে বয়সে মেয়েদের মনে এসে বাসা বাঁধে ঠিক সেই বয়সেই হস্টেলের স্নেহবন্ধনহীন ভাসা-ভাসা জীবনের মধ্যে পড়ে কেমন যেন দায়িত্বহীন আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠেছে সে। হস্টেলে থেকেই একটার পর একটা পরীক্ষায় পাস করে দিল্লীর এক কলেজে চাকরি নিয়ে আবার সেই হস্টেল-জীবনেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বাড়ির সঙ্গে ও দিদিমার সঙ্গে সম্পর্কের সূত্রটা ক্ষীণ হতে ক্ষীণতর হয়ে এখন মাসান্তে এক-আধখানা চিঠিতে এসে পর্যবসিত হয়েছে।
গ্রীষ্মের ছুটিটা যদিও এসে কাশীতে দিদিমার কাছে কাটিয়ে যায়, পুজোর ছুটিতে তাও আসে না। তিন বন্ধুর সঙ্গে মিলিত হয়ে কোথাও না কোথাও গিয়ে ছুটিটা কাটায়।
দিদিমার সঙ্গে মণিকার সম্পর্কটি বড় মধুর। মেয়ে-বন্ধু মণিকার একজনও নেই। মেয়েদের সঙ্গে বন্ধুত্বের কথা উঠলে বলে, মেয়েদের সঙ্গে আবার বন্ধুত্ব হয় নাকি! মনের পরিধি বা ব্যাপ্তি ওদের মধ্যে কোথায়? ছোটখাটো স্বার্থ নিয়েই তো ওরা মশগুল থাকে।
মণিকার বন্ধু অতুল, রণেন ও সুকান্ত দিদিমার পরিচিত।
মধ্যে মধ্যে দিদিমা ঠাট্টা করেছেন নাতনীকে, আচ্ছা মণি, এইভাবে বাউণ্ডুলের মত চাকরি নিয়ে হস্টেলে না থেকে তোর ঐ তিন বন্ধুর মধ্যে যাকে হোক একজনকে বিয়ে করেই না হয় সংসার পাত্ না!
এইবার তুমি ঠিক বলেছ দিদিমা। একজনকে বিয়ে করি আর দুজন মুখ গোমড়া করে বসে থাকুক। জবাবে বলেছে মণি।
দিদিমাও হাসতে হাসতে বলেছেন, তাহলে না হয় কলির দ্রৌপদী হয়ে ওদের তিনজনকেই একসঙ্গে বিয়ে কর ভাই।
ভুলে যাচ্ছ কেন দিদিমা, এটা কলি যুগই। এ যুগে দ্রৌপদীদের সতী বলে কেউ ভোরবেলায় স্মরণ করে না—স্বৈরিণী বলে কলঙ্ক রটায়। তাছাড়া বিয়ে করা মানেই তো দুজনকে হারানো, এতদিনের বন্ধু ওরা আমার, ওদের একজনকেও হারাতে পারব না।
শেষ পর্যন্ত দেখিস ভাই, ওই তিনের বন্ধুত্বই একদিন না তোর পক্ষে বিষ হয়ে ওঠে। কথায় বলে মেয়ে-পুরুষ!
এত বছরেও যখন বিষ হয়নি-বন্ধুত্ব আমাদের জীবনে অমৃত হয়ে থাকবে!
হলেই ভাল। দিদিমা আর প্রসঙ্গটাকে টানতে চান নি। ওই তিন বন্ধুকে নিয়ে দিদিমার কথা ছেড়ে দিলেও, মণিকাকে কম নিন্দা ও গ্লানি সহ্য করতে হয়নি। কিন্তু কোন নিন্দাকেই যেন মণিকা গায়ে মাখতে চায়নি।
অনেকদিন বাদে পূজাবকাশের কয়েকটা দিন আনন্দে হৈচৈ করে কাটাবে বলে মণিকার ওখানে এল সকলে কাশীতে। কিন্তু পৃজাবকাশের আনন্দঘন দিনগুলোর মধ্যে আকস্মিকভাবে এমনি করে যে ভয়াবহ মৃত্যুর ছায়া নেমে আসবে এ কেউ কি ওরা স্বপ্নেও ভেবেছিল! আগের রাত্রে যখন একত্রে সকলে মিলে বসে প্রায় সাড়ে এগারোটা পর্যন্ত হৈ হৈ করে তাস খেলেছে, তখনও তারা বুঝতে কি পেরেছিল রাত্রি প্রভাত হবে দলের একজনের জীবনাবসানের ভিতর দিয়ে! বুঝতে কি পেরেছিল ওরা কেউ চারজনের মধ্যে একজনও যে তাদেরই একজনের পশ্চাতে মৃত্যু এসে নিঃশব্দে দাঁড়িয়েছে! অমোঘ অনিবার্য। অতুল, রণেন, সুকান্ত ও মণিকা। চারজনের মধ্যে যে কেবল দীর্ঘদিনের আলাপ-পরিচয় তাই নয়—নিবিড় ঘনিষ্ঠতাও ছিল। চারজনই অবিবাহিত। অতুল সাইকোলজির প্রফেসর, রণেন ডাক্তার, সুকান্ত ইঞ্জিনিয়ার আর মণিকা প্রফেসর। অতুল, সুকান্ত ও রণেনের মণিকা সম্পর্কে সঠিক মনোভাবটা বাইরে থেকে বোঝা না গেলেও এবং তিনজনের মধ্যে একজনও কথাবার্তায় বা আভাসে-ইঙ্গিতে ঘুণাক্ষরে কখনও কিছু না প্রকাশ করলেও এটা বুঝতে কারোরই অসুবিধা হত না যে, মণিকা সম্পর্কে একটা দুর্বলতা তিন বন্ধুরই আছে। তিন বন্ধুর মধ্যে সর্বপ্রকার আলোচনা হত, কেবল দুটি বিষয় নিয়ে কখনও আলোচনা হত না—পরস্পরের বিবাহ ও মণিকা সম্পর্কে। ওই জায়গাটিতে ওরা যেন অতি সতর্ক ছিল। কোনক্রমে কখনও কোন আলোচনার মধ্যে অতর্কিতেও যদি ঐ দুটি ব্যাপার এসেও যেত প্রত্যেকেই অতি সতর্কতায় এড়িয়ে প্রসঙ্গান্তরে চলে যেত প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই।